শান্তির বদলে কেন যুদ্ধ প্রকল্পে যেতে হচ্ছে ইউরোপকে

২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন।

২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন।ফাইল ছবি: রয়টার্স

সাত দশক ধরে ইউরোপীয় অখণ্ডতার মূলে ছিল শান্তি অনুসন্ধান। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর ইউরোপ এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ইউরোপের শান্তি প্রকল্পকে যুদ্ধ প্রকল্পে পরিবর্তন করতে হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো এখন তাদের বহু বছরের লালিত নীতিগুলো পুনর্বিন্যাস করতে বাধ্য হচ্ছে।

https://10ms.io/1eelWc
বিজ্ঞাপন

অনিবার্যভাবেই ইউরোপের দেশগুলো এখন নিজেদের সামরিক শক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ কারণেই সামরিক খাতে জার্মানির বাজেট বৃদ্ধি, ইউরোপীয় যৌথ নিরাপত্তা উদ্যোগে ডেনমার্কের অংশগ্রহণ এবং ন্যাটোর সদস্যপদ পেতে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের মরিয়া প্রচেষ্টার মতো বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। ট্যাবু ভেঙে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো ইউক্রেনকে ভারী অস্ত্র পাঠাতে শুরু করেছে। অবরোধে বিপর্যস্ত দেশটির জন্য ইইউর ‘শান্তি উদ্যোগ’ থেকে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে। আগ্রাসন শুরুর পর ইইউ তার অর্থনীতিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল; এখন তারা নতুন যুদ্ধ অর্থনীতির পরিকল্পনা করছে, যেখানে নিরাপত্তা প্রথম গুরুত্ব পাচ্ছে।

https://10ms.io/1eelWc
বিজ্ঞাপন

ইউরোপকে এখন দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আবার ভাবতে হবে, সেটি হলো আন্তনির্ভরশীলতা। ইউরোপীয় অখণ্ডতার যে ধারণা, তাতে মনে করা হয়, রাজনৈতিক সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ইউরোপীয় কয়লা ও ইস্পাত সম্প্রদায় (ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভ্রূণ) প্রতিষ্ঠার পেছনে এ ধারণাই কাজ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করার জন্য ইউরোপের দেশগুলো একযোগে কাজ শুরু করেছিল। এতে সাবেক শত্রুদেশ পরিণত হয়েছিল বন্ধুদেশে। এর পেছনে আশা ছিল, অর্থনৈতিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পারস্পরিক উত্তেজনা ও সংঘাত কমানো যাবে।

ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন চালিয়ে এই ধারণাকে রীতিমতো উপহাস করেছে। আন্তনির্ভরতাকে ব্যবহার করে এক পক্ষ যে আরেক পক্ষকে ব্ল্যাকমেল করতে পারে, তার নজিরও স্থাপন করেছে রাশিয়া। এর ঠিক আগেই, কোভিড-১৯ মহামারিকালে ‘মাস্ক কূটনীতি’ এবং ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’-এর কারণে জীবন রক্ষার উপকরণের সংকটে পড়েছিল ইউরোপ। তাতে শিক্ষা নিতে পারায় জ্বালানিসংকট মেটাতে চীনের ওপর কম মুখাপেক্ষী হয়েছে ইউরোপ।

https://10ms.io/1eelWc
বিজ্ঞাপন

ইউরোপের সামনে এখন তৃতীয় প্রশ্নটি হলো, সার্বভৌমত্বের ধারণা। গত কয়েক দশকে ইউরোপ বহুজাতিক সহায়তার ধারণাটিকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। কিন্তু এখন একটা শোধনবাদী শক্তির আগ্রাসনের মুখে তারা নতুন উপলব্ধিতে আসতে বাধ্য হয়েছে। সেটি হলো, আক্রান্ত হওয়ার আগেই সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত করতে হবে।

চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, ইউরোপীয় বিশ্বজনীনতার ভাবনা। শূন্য দশকের প্রথম দিকে হোয়াই ইউরোপ উইল রান দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি শিরোনামে আমি একটা বই লিখেছিলাম। আমি তখন বিশ্বাস করতাম, বৈশ্বিক সহায়তার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মডেলটি বিশ্বের সব জায়গায়ই সমানভাবে বিকশিত হবে। কিন্তু ইইউতে তুরস্ককে গ্রহণ করতে না পারার ব্যর্থতা এবং শোধনবাদী রাশিয়ার উত্থানের ঘটনা থেকে এখন আমার মনে হয়, ইউরোপীয় বিশ্বজনীনতার মডেলটি পুরো বিশ্বে তো দূরে থাক, ইউরোপেই ঠিকমতো পৌঁছাতে পারেনি। সম্প্রতি এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। আমি খুবই মর্মাহত হয়েছি যে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পশ্চিমা নেতারা যেসব ব্যবস্থা নিয়েছেন, তাতে তাঁদের খুব কম মানুষই নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন। তাঁরা এই সংঘাতকে ইউরোপের আঞ্চলিক সংঘাত হিসেবেই দেখেন।

https://10ms.io/1eelWc
বিজ্ঞাপন

ইউরোপীয়দের ইউরোকেন্দ্রিকতা ধারণাটি শুধু রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও ভ্লাদিমির পুতিনকেই ভুল বার্তা দেয়নি, বাকি বিশ্বের কাছেও ইউরোপের আবেদন পৌঁছাতে তা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধারণাকে বদলাতে হলে ইউরোপের নেতাদের এখন নতুন উপলব্ধিতে আসা প্রয়োজন। সেটি হলো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্দিষ্ট ইতিহাস ও ভূগোলের ব্যতিক্রম এক অভিজ্ঞতা। ইউরোপকে অবশ্যই ভিন্ন চোখে বাকি বিশ্বকে দেখতে হবে। বহু মেরুর বিশ্বে ইউরোপকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। সেটাই হতে পারে বিশ্বে ইউরোপের ক্ষমতাচর্চার প্রথম প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *