রিকশা চালিয়ে অলিগলি ঘুরছেন আর কাঁদছেন ইদ্রিস আলী

মেয়েদের ছবি হাতে শহরের অলিগলি ঘুরছেন ইদ্রিস আলী। অপেক্ষায় আদরের মেয়েদের ফিরে পাওয়ার৷ 
বুধবার নারায়ণগঞ্জ নগরের আল্লামা ইকবাল রোডে

মেয়েদের ছবি হাতে শহরের অলিগলি ঘুরছেন ইদ্রিস আলী। অপেক্ষায় আদরের মেয়েদের ফিরে পাওয়ার৷ বুধবার নারায়ণগঞ্জ নগরের আল্লামা ইকবাল রোডে 

দিনাজপুরের কৃষক ইদ্রিস আলী এখন নারায়ণগঞ্জ শহরে রিকশা চালান। গ্যারেজের জমা টাকা আর খাবারের খরচ উঠে গেলে রিকশায় আর যাত্রী নেন না। খালি রিকশা নিয়েই দিনরাত ব্যস্ত শহরের অলিগলিগুলোতে ঘোরেন। ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী কন্যাশিশু দেখলেই রিকশা থামিয়ে ছুটে যান।

https://10ms.io/6wmHqt
বিজ্ঞাপন

কখনো কখনো সড়কের মধ্যেই রিকশায় বসে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। তাঁর কান্না দেখে লোকজন ভিড় করলে ইদ্রিস দুটি ছবি উঁচিয়ে ধরেন। সবার কাছে জানতে চান, ছবির এই শিশু দুটিকে কেউ দেখেছে কি না।

বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ শহরের আল্লামা ইকবাল রোড এলাকায় রিকশায় বসে কাঁদতে দেখা যায় ইদ্রিসকে। কাছে গিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইলে বিলাপ জুড়ে দেন। কথা বলার আগে ঘামে ভেজা নিজের গামছা মুখে চেপে ধরেও কান্না থামাতে পারেন না।

কান্না জড়ানো কণ্ঠেই বলেন, ‘আমার জীবনের সব হারিয়ে ফেলেছি ভাই। পাগলের মতো রাস্তাঘাটে খুঁজে বেড়াচ্ছি, কোনো জায়গায় পাচ্ছি না। খাওয়াদাওয়া, ঘুম—কিচ্ছু হচ্ছে না। অলিগলি সব জায়গায় খুঁজে বেড়াচ্ছি রিকশা নিয়া। কিন্তু আমার মেয়েগুলা কই আছে, কী খাচ্ছে, কিছুই জানতে পারছি না।’

https://10ms.io/ywmG5m
বিজ্ঞাপন

নিজের সব হারানোর গল্প বলেন দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার কৃষক ইদ্রিস আলী। এক বছর আগেও স্ত্রী শাহানাজ আর দুই মেয়েকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল তাঁর। ইদ্রিসের পৃথিবী বলতেই ছিল ৯ বছর বয়সী মেয়ে ইতি আক্তার ও ৫ বছরের মিম। এরই মধ্যে একদিন গ্রামের দালালের খপ্পরে পড়েন ইদ্রিসের স্ত্রী শাহনাজ। বিদেশে যেতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। বাদ সাধেন ইদ্রিস। ‘ছোট্ট মেয়েদের ফেলে বিদেশ যেতে হবে না।

ইতি আক্তার ও মীম
ইতি আক্তার ও মীম

আমরা তো সুখেই আছি।’—ইদ্রিসের বাধা মানতে চান না স্ত্রী।
দালালের প্ররোচনায় একরাতে পালিয়ে বাড়ি ছাড়েন শাহনাজ। সঙ্গে নিয়ে আসেন দুই মেয়েকে। তারপর আর খোঁজ মেলেনি স্ত্রী–সন্তানদের। তখন থেকেই ঢাকা নারায়ণগঞ্জ আর গাজীপুরের অলিগলি ঘুরে স্ত্রী–সন্তানদের খোঁজা শুরু করেন। প্রিয়জনদের খুঁজতে এসে দিনাজপুরের কৃষক ইদ্রিসের পরিচয় পাল্টে হয়ে যায় ‘রিকশাওয়ালা’।

ইদ্রিস জানান, গ্রামের সেই দালালের লোকজন বলাবলি করছে, তাঁর স্ত্রী মেয়েদের শহরে রেখে বিদেশে চলে গেছে। সে কথা শুনেই প্রথমে ঢাকা, পরে গাজীপুরে যান ইদ্রিস। থাকা–খাওয়ার টাকা জোগাড় করতে নির্মাণশ্রমিকের কাজ শুরু করেন, বাকি সময় স্ত্রী–সন্তানদের খোঁজেন। প্রায় এক বছরেও সন্তানদের খুঁজে পান না। এরই মধ্যে সম্প্রতি ইদ্রিসের মুঠোফোনে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে। কথা হয় তাঁর বড় মেয়ের সঙ্গে। মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার আকুতি জানান। জানতে পারেন, মেয়েরা তাঁর শাশুড়ির কাছে আছে। শাশুড়ি নারায়ণগঞ্জের বিসিক এলাকায় কোনো এক তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক। ইদ্রিস তখনই ছুটে আসেন নারায়ণগঞ্জে। কিন্তু শেষবার মেয়ের সঙ্গে কথা বলার পর থেকেই সেই মুঠোফোন নম্বর বন্ধ।

https://10ms.io/JwmGmp
বিজ্ঞাপন

প্রায় ৬৯০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জেলায় হারানো দুই মেয়েকে কোথায় খুঁজবেন, কীভাবে খুঁজবেন, তার উপায় না পেয়ে বেছে নেন রিকশা। ১৫ দিন পর এসেও ইদ্রিস জানে না, লাখ লাখ মানুষের এই যান্ত্রিক শহরে কোন জাদুকর এসে তাঁর মেয়েদের খোঁজ দেবেন।

ইদ্রিসের বড় মেয়ে গ্রামের বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। কথা ছিল, এ বছর ছোট মেয়েও স্কুলে ভর্তি হবে। স্বপ্ন ছিল, আদরে–সোহাগে মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করবেন। ইদ্রিস এখনো সেই আশায় আছেন, মেয়েদের খুঁজে পাবেন তিনি। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আবার স্কুলে ভর্তি করবেন।

https://10ms.io/WwmGDg
বিজ্ঞাপন

মুঠোফোনে কথা হয় দিনাজপুরে থাকা ইদ্রিসের বড় ভাই হবিবর আলীর সঙ্গে। জানান, বিয়ের পর থেকে সুখের সংসার ছিল ইদ্রিসের। হঠাৎ একদিন জানতে পারেন, গ্রামের এক দালালের খপ্পরে পরে ইদ্রিসের স্ত্রী মেয়েদের নিয়ে বাড়ি ছেড়েছে। তাঁরা তখন থানা-পুলিশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গ্রামের মেম্বার–চেয়ারম্যানদের বাধায় তা আর হয়ে ওঠেনি।

কথা হয় ইদ্রিসের এলাকার ৩ নম্বর মুকুন্দপুর ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য সুমন চন্দ্র দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ইদ্রিসকে তিনি চেনেন। মেয়ে ও স্ত্রী হারানোর ঘটনাও সত্য। পুলিশের সহায়তা নিতে কেন বাধা দেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে বলেন, তিনি সদ্য নির্বাচিত হয়েছেন। এ বিষয়ে জানেন না।

https://10ms.io/8wmD9U
বিজ্ঞাপন

ঘটনার এক বছর পর মঙ্গলবার রাতে মেয়েদের খোঁজ চেয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন ইদ্রিস আলী। ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রকিবুজ্জামান আশ্বাস দিয়েছেন, মেয়েদের খুঁজে পেতে তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবেন। খুঁজে পেলে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *