বিচ্ছেদ কি শেষ সমাধান
বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও একবার ভেবে দেখতে পারেন কোনো উপায় আছে কি না। প্রতীকী এই ছবির মডেল: কোকো ও বৃষ্টিসুমন ইউসুফ
ছোটবেলায় পড়া রূপকথার রাজা–রানির গল্পের শেষ লাইনটি নিশ্চয়ই মনে আছে? অনেক দুঃখ, বিপদ, ষড়যন্ত্র পার হয়ে সব গল্পেরই শেষে রাজা ও রানি সুখে–শান্তিতে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেন। তবে বাস্তবের গল্পটা সব ক্ষেত্রে এমন হয় না।
হাতে হাত ধরে জীবনপথের চড়াই–উতরাই পার করতে গিয়ে কখনো কখনো হাত ছুটে যায়। পথটা দুই দিকে যায় বেঁকে। পথের প্রান্তে দাঁড়িয়ে তবু কি দুজনের কখনো মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতার সেই ছত্রগুলো? একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মন কি বলে ওঠে ‘আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি’। কোনো এক বিষণ্ন সন্ধ্যায় দুজনের একজনের কী মনে হয়, কুমার বিশ্বজিতের গানের মতো কেন বলিনি, ‘চন্দনা গো, রাগ করো না, অভিমান করে বলো, আর কি হবে?’
রূপকথা, সাহিত্য বা গানে বিচ্ছেদের বেদনা যতই মধুর হোক না কেন, বাস্তবে বিচ্ছেদ ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক জীবনে বয়ে আনে তিক্ততা আর জটিলতা। বিচ্ছেদে এখন পকেটের খরচও কিন্তু কম নয়। নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট অনুসারে এখন কেউ বিবাহবিচ্ছেদ করতে চাইলে বাড়তি দেড় হাজার টাকা গুনতে হবে। এত দিন ডিভোর্স ইন্সট্রুমেন্টে স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হতো ৫০০ টাকা।
বিচ্ছেদে দুজনের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অন্য জীবনগুলোও অসহায় হয়ে পড়ে। মা-বাবার বিচ্ছেদে সন্তানের জীবনে শুরু হয় টানাপোড়েন। ভেবে দেখুন জাপান থেকে আসা দুই শিশুর কথা। মা না বাবা কার কাছে থাকবে, কার কাছে ছুটি কাটাবে, এ নিয়ে কত জটিলতায় পড়তে হয়েছে দুই শিশুকে। হতে হয়েছে গণমাধ্যমের খবর।
মাত্র এক দশক আগেও বিবাহবিচ্ছেদ শব্দটা কম উচ্চারিত হতো। তবে এখন যেন তা অনেকটাই ডালভাত। বিশ্বায়নের যুগে পাশ্চাত্যের জীবনধারার প্রভাব পড়েছে প্রাচ্যে। তাই শহুরে, উচ্চবিত্ত সমাজে বড় জটিলতার পাশাপাশি অনেক ছোট কারণেও বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ। ‘তোমার সঙ্গে আর সংসার করা যাচ্ছে না’ কথাটা বলাও যেন এখন সহজ। পরিসংখ্যান বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ঢাকায় বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বেড়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, করোনা মহামারির সময়ে ঢাকায় দৈনিক ৩৯টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতি ৩৭ মিনিটে একটি বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে।
বিবাহবিচ্ছেদের প্রবণতা যে কেবল করোনার সময় বেড়েছে, তা নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, কয়েক বছর ধরে দেশে বিবাহবিচ্ছেদের প্রবণতা বাড়ছে। শিক্ষিত স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে এটা বেশি হচ্ছে। ২০১৯ সালের জুন মাসে প্রকাশিত ‘দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছে ১৭ শতাংশ।
তথ্য পরিসংখ্যান বাদ দিয়ে চারপাশটা দেখলেও বোঝা যায়, বাড়ছে বিচ্ছেদ। বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসেবে বেশির ভাগই বলছেন বনিবনা না হওয়ার কথা। তবে বনিবনা না হওয়ার কিছু কিছু কারণ শুনে মনে হয়, আরেকবার কি ভাবা যেত না? আরেকটু কি চেষ্টা করা যেত না। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বন্ধনটা একেবারে ছিঁড়ে গেলে তা মেরামত করা কঠিন। তবে বন্ধনটা যখন থেকে আলগা হতে শুরু করে, তখন থেকে বুননটা শক্ত করার চেষ্টা করতে পারেন দুই পক্ষই। আর তাতে সুফলও মেলে।
এমনই এক ঘটনার কথা শোনালেন মনোবিদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজীর আহমেদ। বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তের দিকে যাওয়ার আগে এক দম্পতি শেষ চেষ্টা হিসেবে কাউন্সেলিংয়ের জন্য গিয়েছিলেন তাঁর কাছে। দুজনের ছোট অভিযোগগুলো জড়ো হতে হতে বড় ব্যবধান তৈরি হয়েছিল তাঁদের সম্পর্কে। দুজনেই কর্মজীবী। স্ত্রীর অভিযোগ ছিল, অফিস থেকে ফিরে তাঁকেই ঘরের সব কাজ করতে হয়। স্বামী টুকটাক কাজ করলেও সেটা যথেষ্ট নয়। আর স্বামীর যুক্তি যদি নারী-পুরুষের সমতার কথাই বলা হয় তাহলে স্ত্রীর উচিত তাঁর বেতন সংসারে ব্যয় করা। কিন্তু স্ত্রী তা করেন না। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, দুজন এই সমস্যা নিয়ে কেবল ঝগড়াই করে গেছেন। কখনো ঠান্ডা মাথায় বসে আলোচনা করেননি। একে অন্যের অবস্থানে গিয়ে তার মনোভাব বোঝারও চেষ্টা করেননি। মনোবিদ শুরুতে তাঁদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন। পরে দুজনের কথাগুলো একসঙ্গে তাঁদের সামনে উপস্থাপন করেন। একে অন্যের অভিযোগগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে, সমাধানের উপায় খোঁজার পরামর্শ দেন। আলোচনার পর তাঁরা নিজেরাই সমাধানের পথ খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের আর বিচ্ছেদ হয়নি।
সংসারজীবনে এই আরেকটু ভাবা আর আলোচনাটা কখনো কখনো খুব জরুরি হয়ে ওঠে। মনোবিদ তানজীর বলেন, ‘বেশির ভাগ স্বামী-স্ত্রী চোখে চোখ রেখে কথা বলেন না। একে অন্যের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেন না। যৌন সম্পর্কের বাইরে একে অন্যকে স্পর্শ করেন না। ফলে দুজনের দূরত্ব বাড়ে। এ ছাড়া অনেক সময় স্বামী–স্ত্রী একে অন্যকে প্রতিযোগী ভাবতে থাকেন। সমঝোতা বা মানিয়ে চলাকে দুই পক্ষই মনে করে হেরে যাওয়া। কিন্তু শেষ বিচারে ঝগড়া বা জেদ জিতলেও হেরে যায় সম্পর্কটা।’ এসব সমস্যার সমাধানে ‘ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স’–এর (আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা) ওপর এখন জোর দিচ্ছেন মনোবিদেরা। সহজ কথায় আবেগ নিয়ন্ত্রণ। কষ্ট, দুঃখ, রাগ—এ ধরনের আবেগের ব্যবস্থাপনার বিষয়টি জানা দরকার। কোন পরিস্থিতিতে কতটুকু ভালোবাসা প্রকাশ করা দরকার আর কতটুকু রাগ প্রকাশ করা দরকার, সেটার শিক্ষা কৈশোর থেকেই শুরু করা উচিত। অনেকেই আছেন রেগে গেলে হাতের কাছের জিনিসপত্র ভাঙচুর করেন। একে অন্যকে মারধর করেন। এ সমস্যারও সমাধান করতে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বাড়ানো জরুরি।
তপন সিংহ পরিচালিত সাদাকালো যুগের গল্প হলেও সত্যি সিনেমার সংলাপ মনে পড়ে গেল। যেখানে দুই জায়ের ঝগড়ার একপর্যায়ে উদাসভাবে ছায়া দেবী বলেন, ‘পাঁচটা বাসন থাকলে ঠোকাঠুকি তো হবেই।’ শুধু স্বামী–স্ত্রী নয়, জীবনে মা-বাবা, ভাইবোন, সহকর্মী, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা—কতজনেরই তো কত কিছু মেনে নিই আমরা। সংসারজীবনেও দুই পক্ষের জন্যই এই মানিয়ে চলাটা জরুরি। প্রাক্তন সিনেমায় উজানের দ্বিতীয় স্ত্রী মলি যেমন বলেছিলেন, ‘আমার কাছে অ্যাডজাস্টমেন্ট মানে হেরে যাওয়া নয়, সুন্দর করে বাঁচা।’
এটাও সত্যি, সব ক্ষেত্রে মেনে নেওয়া উচিত নয়। মানিয়ে চলারও একটা সীমারেখা থাকা দরকার। মানিয়ে চলতে গিয়ে যদি জীবনের ছন্দপতন ঘটে, তাহলে সমাপ্তি টানতেই হবে। স্ত্রী বা স্বামীর ওপর শারীরিক, মানসিক নির্যাতন, স্বামী বা স্ত্রীর পরকীয়া, যৌতুকের মতো অপরাধের প্রতিবাদ ও প্রতিকার করা প্রয়োজন। আবার ভুল সংশোধনেরও সুযোগ আছে। তবে সংশোধন না হলে বিচ্ছেদ ছাড়া উপায় থাকে না।
শেষে এসে বলা যাক, আরেকটি ছোট্ট গল্প। এক প্রতিবেশী রোজই শুনতে পান আরেক প্রতিবেশীর ঘরের নিত্যদিনের ঝগড়া। শোনেন আর ভাবেন, রোজ এত অশান্তি নিয়ে একসঙ্গে থাকার কী দরকার। সেই প্রতিবেশীই এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় দেখলেন রোজ ঝগড়া করা দম্পতিটি তাঁদের দুই সন্তানকে নিয়ে একসঙ্গে বসে ক্যারম খেলছেন। পাশে রাখা ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিয়ে গল্প করছেন। প্রতিবেশী ভাবলেন, জীবনটা এমনই। এপিঠে সুখ তো ওপিঠে দুঃখ। এই দম্পতি যদি আলাদা হয়ে যেতেন, এমন সুন্দর পারিবারিক দৃশ্যটি তিনি দেখতে পেতেন না। এই সুখটুকু পেতে অসুখকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করলে হয়তো বিচ্ছেদ অনেক ক্ষেত্রেই ঠেকানো সম্ভব।