বহুজাতিকের চাকরি ছেড়ে চামড়ায় সফল ব্যবসায়ী

বহুজাতিকের চাকরি ছেড়ে চামড়ায় সফল ব্যবসায়ী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েই বহুজাতিক কোম্পানি পাকিস্তান টোব্যাকোতে (বর্তমানে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো) চাকরি পান। করাচিতে শুরু করেন কর্মজীবন। ১৯৭০ সালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে বদলি হন ঢাকায়। মাঝে কয়েক মাসের জন্য কর্মস্থল ছিল বিলেত। উচ্চ পদে। মাইনেও বেশ। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও অনেক। তারপরও অভিজাত নিশ্চিত জীবন ছেড়ে বেছে নিলেন দুর্গন্ধময় হাজারীবাগ। দামি গাড়ি ছেড়ে উঠলেন রিকশায়। চামড়ার ভাঁজে খুঁজে নিলেন নতুন এক অধ্যায়।

৪৯ বছর আগে বহুজাতিক কোম্পানির চাকরি ছেড়ে চামড়ার ব্যবসায় যুক্ত হওয়া সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী এখন চামড়া খাতের একজন সফল ব্যবসায়ী। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশে উৎপাদিত চামড়ার জুতার বিদেশযাত্রা (রপ্তানি) শুরু হয়। রপ্তানির পাশাপাশি দেশের জুতার বাজারেও অন্যতম শীর্ষস্থান দখল করেছে তাঁর প্রতিষ্ঠান অ্যাপেক্স। যদিও ছোটবেলায় বাবা-ভাইদের যখন বড় হয়ে ব্যবসায়ী হওয়ার কথা বলতেন, তখন হেসেই উড়িয়ে দিতেন। বলতেন, ‘তুই ব্যবসার কী বুঝিস। আমাদের চৌদ্দ পুরুষে কেউ ব্যবসায়ী নাই।’

১৯৭২ সালে মঞ্জুর ইন্ডাস্ট্রিজ নামে কোম্পানি করে কমিশনের ভিত্তিতে চামড়া বিক্রির ব্যবসায় নামেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। চার বছর পর ১৯৭৬ সালে ১২ লাখ ২২ হাজার টাকায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন ওরিয়েন্ট ট্যানারি কিনে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাপেক্স ট্যানারি। তারও ১৪ বছর পর যাত্রা শুরু করা অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার এখন দেশের শীর্ষ জুতা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে অ্যাপেক্স গ্রুপে কাজ করেন ১৭ হাজারের বেশি কর্মী। তাঁদের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ ১ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা।

সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী

অবশ্য সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীকে শুধু সফল ব্যবসায়ীর গণ্ডির মধ্যে রাখলে ভুল হবে। তিনি ১৯৯৬ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তখন যোগাযোগ, নৌপরিবহন, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিলেন। ২০০১ সালেও ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। তার বাইরে সংগঠক হিসেবেও অনেক কাজ করছেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ঢাকার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যও তিনি।

‘স্বপ্ন ছিল চাকরি করব না’

কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৪২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জন্ম নেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। তাঁর বাবা স্যার সৈয়দ নাসিম আলী (১৮৮৭-১৯৪৬) কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান ১৯৩৩ সালে। তার এক যুগ পর তিনি প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধি দেয়। বড় ভাই এস এ মাসুদ যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। পরে তিনিও কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক ছিলেন। বাবার মতো তিনিও ১৯৭৭ সালে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। আর মেজ ভাই এস এ মওদুদ বিলেত থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করে যোগ দেন সিভিল সার্ভিসে। আর সেজ ভাই এস এ মনসুর ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী কলকাতাতেই স্কুল ও কলেজের পাট শেষ করেন। ১৯৬২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি নেন। তারপর স্নাতকোত্তর করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬৪ সালে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। থাকতেন সলিমুল্লাহ মুসলিম (এস এম) হলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করতেন। সে সময় ডাকসুর ভিপি ছিলেন তাঁর সহপাঠী রাশেদ খান মেনন (বর্তমানে সাংসদ)। আর জি এস ছিলেন মতিয়া চৌধুরী (সাবেক কৃষিমন্ত্রী)।

সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বললেন, ‘ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল চাকরি করব না; ব্যবসা করব, নিজের পায়ে দাঁড়াব। প্রত্যেক মানুষেরই স্বপ্ন থাকে; আমারও ছিল। তো এক–দুবার ব্যবসার কথা বললে আমার ভাইয়েরা হাসাহাসি করল। বলল, “তুই ব্যবসার কী বুঝিস। আমাদের চৌদ্দ পুরুষ কেউ ব্যবসা করেনি।” এমনিতেও ব্যবসায়ীদের প্রতি আমার পরিবারের ভালো ধারণা ছিল না। সব মিলিয়ে ব্যবসাবিরোধী একটা মনোভাব তো আমাদের সমাজে আছে। তখন সেটি আরও বেশি ছিল।’

 সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী

পাকিস্তান টোব্যাকোতে চাকরি

ছোটবেলা থেকে চাকরি না করার স্বপ্ন দেখলেও বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। সেই ঘটনাও বেশ চমকপ্রদ। এমএ পরীক্ষার পর অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে সিএসপি (সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান) পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা শুরু করেন। তবে সেই পরীক্ষায় বসার আগেই অনেকটা আকস্মিকভাবে তাঁর চাকরি হয়ে যায়। বাকিটা শুনুন তাঁর মুখেই:

তখন সিএসপি পরীক্ষা হতো সেপ্টেম্বরে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল আগস্টে এমএ পরীক্ষা দিয়ে পড়াশোনা করে সিএসপিতে বসব। তবে এমএ পরীক্ষার আগে কার্জন হলে এক অনুষ্ঠানে এলেন তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খান। তখন আমরা যারা রাজনীতি করি, তারা গভর্নরের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করিনি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। ভালো ব্যবহার না করার শাস্তিস্বরূপ গভর্নর এমএ পরীক্ষা তিন মাস পিছিয়ে দিলেন। ফলে সে বছর আর সিএসপিতে বসা হলো না। এটি ১৯৬৪ সালের কথা।

শেষে ডিসেম্বরে এমএ পরীক্ষা দিলাম। সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। বাড়ি থেকে মাসে মাসে পয়সা আসছে। খাচ্ছিদাচ্ছি। পড়াশোনা করছি। সঙ্গে রাজনীতি তো আছেই। একদিন জিন্নাহ অ্যাভিনিউ (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, মণি, মণি (আমার ডাকনাম) বলে কেউ একজন ডাকছে। পেছনে তাকাতেই দেখি, আমাদের পারিবারিক বন্ধু হুমায়ূন খান। বললেন, এদিকে আয়। যেতেই জিজ্ঞেস করলেন, কী করছিস? বললাম, পরীক্ষা শেষ। এখন সিএসপি পরীক্ষা দেব। হুমায়ূন বললেন, সরকারি চাকরি কোনো চাকরি হলো? কোম্পানির চাকরি কর। আমি হেসে বললাম, আমাকে চেনেটা কে? কে চাকরি দেবে?

স্ত্রী প্রয়াত নিলুফার মঞ্জুর, ছেলে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর ও মেয়ে মুনিজে মঞ্জুরের সঙ্গে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী
স্ত্রী প্রয়াত নিলুফার মঞ্জুর, ছেলে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর ও মেয়ে মুনিজে মঞ্জুরের সঙ্গে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী

এ কথা শুনে হুমায়ূন আমাকে জোর করে তাঁর অফিসে নিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, তাঁর শ্যালক আনোয়ার দৌজা পাকিস্তান টোব্যাকোতে বিপণন বিভাগে কাজ করেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। সেদিনই। প্রস্তুতি না থাকলেও গেলাম। আনোয়ার দৌজার সঙ্গে কথা বলতে বলতে জানলাম তিনি আমার বাবার হাইকোর্টে কর্মচারী ছিলেন। বললেন, জীবনবৃত্তান্ত আছে? আমি তো অবাক, জীবনবৃত্তান্ত আর কী থাকবে, নাম, জন্ম, বিএ, এমএ…আর তো কিছু নেই। বললেন, ওইটাই লিখো। একটা কাগজে লিখে দিয়ে এলাম। তারপর ভুলেও গেলাম।

সপ্তাহ তিনেক পর, জানুয়ারি মাসের (১৯৬৫ সাল) শেষ সপ্তাহে আনোয়ার দৌজা এসএম হলে হাজির। তখন তো আর মোবাইল ছিল না। হলে একটি টেলিফোন ছিল, সেটি আবার সব সময় থাকত ডেড (নষ্ট)। বললেন, আমি তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছি। তোমাকে একটা সাক্ষাৎকার দিতে হবে, করাচিতে। সামনের সপ্তাহে যেতে পারবে? বললাম, পারব। সাক্ষাৎকার বোর্ডের সবাই ইংরেজ। তাঁরা আমার সম্পর্কে বলতে বললেন। বললাম, নিজের সম্পর্কে কী বলব। নাথিং টু সে (বলার কিছু নেই)। তখন বোর্ডের একজন বললেন, এই চাকরিতে কি তুমি সত্যি আগ্রহী? আমি খুব একটা আগ্রহী ছিলাম না। কিন্তু সেটা তো মুখের ওপর বলা যায় না। বললাম অবশ্যই আগ্রহী। তখন তারা কত বেতন চাই জানতে চাইলেন।

বহুজাতিকের চাকরি ছেড়ে চামড়ায় সফল ব্যবসায়ী
ছবি: সংগৃহীত

বেতনের বিষয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। তখন সিএসপি অফিসাররা ৪৫০ রুপিতে চাকরিজীবন শুরু করতেন। সে সময় প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ছিল ৩ রুপি। খানিকটা ভেবে আমি বললাম, ১ হাজার রুপি। পরক্ষণে আবার বললাম, ৯০০ দিলেও চলবে। বোর্ডের সদস্যরা মুচকি মুচকি হাসছেন। আমি ভাবলাম, বোধ হয় বেশি চেয়ে ফেলেছি। অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। তখন বললাম, ৬০০ রুপি হলেও হবে। তখন তারা জোরে জোরে হাসতে শুরু করলেন। কোম্পানির অর্থ পরিচালক বললেন, আমরা তোমাকে ৬০০ রুপি দিতে পারব না। আমি বললাম, ঠিক আছে। তিনি বললেন, ঠিক নেই। আমরা তোমার জন্য আমাদের পে স্কেল পরিবর্তন করতে পারব না। তুমি কি ১ হাজার ৯০০ রুপি নেবে? তখন আমি ভাবছি, তাঁরা বোধ হয় মজা করছেন। বললাম, অবশ্যই। তখন তাঁরা বললেন, আমাদের সঙ্গে লাঞ্চে (দুপুরের খাবার) চলো।

বহুজাতিকের চাকরি ছেড়ে চামড়ায় সফল ব্যবসায়ী
ছবি: সংগৃহীত

চাকরি ছেড়ে চামড়ার ব্যবসায়

সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী পাকিস্তান টোব্যাকোতে যোগ দেওয়ার পর করাচিতেই দুই বছরের প্রশিক্ষণে অংশ নিলেন। শর্ত ছিল এই সময়ে বিয়ে করা যাবে না। কিন্তু হবু শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর মেয়ের বাড়ি থেকে চাপ এল। তখনো প্রশিক্ষণ শেষ হয়নি। বসকে অনুরোধ করলেন। শেষে পাঁচ মাস আগেই তাঁর চাকরি চূড়ান্ত করে দিল কর্তৃপক্ষ। তবে কর্মস্থল সেই করাচি। ১৯৬৬ সালে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী জয়পুরহাটের সাংসদ মফিজ চৌধুরীর মেয়ে নিলুফার মঞ্জুরকে বিয়ে করলেন।

১৯৭০ সালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে গেলে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীকে ঢাকায় বদলি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান আর্মি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর শ্বশুর মফিজ চৌধুরীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি ভারতে চলে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাজ করতে থাকেন। সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীকে ভারতে চলে যেতে পরামর্শ দেন শ্বশুর। তিনি সেটা না করে সেপ্টেম্বরে স্ত্রীকে নিয়ে বিলেতে বদলি হয়ে চলে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার ১১-১২ দিনের মাথায় আবার ফিরে আসেন। চাকরি শুরু করলেন। তাঁকে চট্টগ্রামে বদলি করে দেওয়া হলো।

কারখানায় কাজ তদারকি করছেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী
কারখানায় কাজ তদারকি করছেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী

শনি ও রোববার সাপ্তাহিক ছুটি। শ্বশুর তখন মন্ত্রী। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ঢাকায় মিন্টো রোডে শ্বশুরের বাসায় উঠতেন। ১৯৭২ সালের মে-জুন মাসে একদিন শ্বশুর মফিজ চৌধুরী তাঁর বাসায় লিহাই ইউনিভার্সিটি বন্ধু এফআইসিসিআইয়ের সভাপতি সঞ্চয় সেন ও অন্য সফরসঙ্গীদের নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করেছেন। সেখানে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীও উপস্থিত। তো অনুষ্ঠানে এক ফরাসি ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়।

সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, নৈশভোজে রেমন্ড ক্লেয়ার নামের ওই ফরাসি ব্যবসায়ী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী করো? বললাম, চাকরি করি। আমিও জানতে চাইলাম তিনি কী করেন। বললেন, ব্যবসা করি। জার্মানি থেকে রাসায়নিক আমদানি করি। আবার ঢাকা থেকে চামড়া কিনে নিয়ে যাই। দেশে তখনো অস্থিরতা চলছে। কোনো বিদেশি ব্যবসা করতে দেশে আসবেন, বিশ্বাস হলো না। তা ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর তখনো চালু হয়নি। সন্দেহ থেকে জিজ্ঞেস করলাম, চামড়া কীভাবে নেন? বললেন, আমি কার্গো উড়োজাহাজ পুরোটা ভাড়া নিয়ে রাসায়নিক আনি, তারপর আবার চামড়া কিনে সেটিতে ভরে নিয়ে যাই। আমি তো অবাক। ভাবলাম, বাড়িয়ে বলছে হয়তো। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমাকে এসব বলছ কেন? বললেন, তুমি আমার কোম্পানিতে জয়েন করবে? হেসে বললাম, আমি ভালো চাকরি করি। মাইনে ভালো। তোমার কোম্পানিতে কেন জয়েন করব। বললেন, আমি জয়েন করতে বলছি না। তোমাকে আমার কোম্পানির এজেন্ট হতে বলছি। কমিশনে ব্যবসা করবে।

আমি কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম, কেমন কমিশন। রেমন্ড ক্লেয়ার আমাকে বললেন, এত এত কমিশন পাবে। হিসাব–টিসাব করে দেখলাম অনেক টাকা। কিন্তু সমস্যা বাঁধল অন্যখানে। বউকে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করার কথা বললাম, সে তো হাসে। বলে, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বড় ভাইকে বললাম, সেও হাসে। বলে, ভালো চাকরি করছ। আমার তখন জেদ চেপে গেল। শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁর সঙ্গে আমরা বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তাঁকে ঘটনা খুলে বললাম। তিনি বললেন, ভালো তো, করো। বললাম, আপনার মেয়ে তো রাজি হচ্ছে না। শ্বশুর তখন বললেন, আমি রাজি করাব।

১৯৭২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর নিজের ৩০তম জন্মদিনে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী চাকরি ছাড়লেন। তখন তাঁর মাসিক বেতন অনেক টাকা। তার বাইরে বাড়ি–গাড়িসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও ছিল। চাকরি ছাড়ার আগে তিনি বিএটির ঢাকা কারখানার ফাইন্যান্স ম্যানেজার ছিলেন। বললেন, রিকশায় করে আমি হাজারীবাগ যেতাম। দুর্গন্ধের মধ্যে ঘুরে ঘুরে চামড়া কিনতাম। তবে কাজটি করতে বেশ আনন্দ পাচ্ছিলাম। নিজেকে বেশ স্বাধীন স্বাধীন মনে হতে লাগল।

সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী

প্রথমে ট্যানারি, পরে জুতার ব্যবসা

হাজারীবাগ থেকে চামড়া কিনে রেমন্ড ক্লেয়ারের হল্যান্ডার গ্রুপের কাছে কমিশনে বিক্রি করে ভালোই ব্যবসা করছিলেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। তখন সব ট্যানারি রাষ্ট্রমালিকানাধীন। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সরকার ট্যানারি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরের বছর প্রথমে ওরিয়েন্ট ট্যানারি নিলামে তোলা হয়। সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী তাতে অংশ নিলেন। সর্বোচ্চ ১২ লাখ ২২ হাজার টাকা দরপ্রস্তাব করে ওই ট্যানারি কিনে নিলেন। তখন যাত্রা শুরু করল অ্যাপেক্স ট্যানারি। এতে তাঁর সঙ্গে মালিকানায় রয়েছেন এ কে এম রহমতুল্লাহ (ঢাকা-১১ আসনের সাংসদ)।

ট্যানারিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করা শুরু করলেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। জাপানি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান মিজুজে ছিল চামড়ার প্রথম ক্রেতা। ধীরে ধীরে ক্রেতা বাড়তে থাকল। ১৪ বছর এভাবেই ব্যবসা চলল। তারপর ভাবতে লাগলেন, যেহেতু চামড়ার সর্বশেষ গন্তব্য হচ্ছে জুতার কারখানা; তাহলে কেন জুতার কারখানা হবে না। যেই ভাবা সেই কাজ। গাজীপুরের সফিপুরে ৫০ বিঘা জমিতে জুতার কারখানা স্থাপনে হাত দিলেন। ১৯৯০ সালে যখন কারখানার মাটি কাটা শুরু হলো, তখন একমাত্র ছেলে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর দেশে ফিরে প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত হলেন।

বুয়েটের একজন স্থপতির নকশায় কারখানা ভবন নির্মিত হয়। বিদেশ থেকে আসে আধুনিক যন্ত্রপাতি। ১৯৯১ সালে প্রথম ধাপে ১৫০ জন শ্রমিক দিয়ে দৈনিক এক হাজার জোড়া জুতা উৎপাদনের সক্ষমতার এই শতভাগ রপ্তানিমুখী কারখানাটি চালু হলো। জার্মানিতে জুতা রপ্তানি হতে থাকল। তবে অনভিজ্ঞতা, নিম্নমান ও সঠিক সময়ে সরবরাহ করতে না পারায় দ্বিতীয় মৌসুমেই ক্রয়াদেশ কমতে থাকে। তখন দুশ্চিন্তায় পড়ে যান উদ্যোক্তারা। আবার নতুন ক্রেতা খুঁজতে থাকেন।

অ্যাপেক্স ট্যানারির চামড়ার জাপানি ক্রেতা ওশান ট্রেডিং ও মিজুজের সূত্র ধরে দেশটির বৃহত্তম জুতা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান মারুটোমির মালিকের সঙ্গে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর পরিচয় হয়। অনেক অনুরোধের পর প্রতিষ্ঠানটি চাকরিজীবী পুরুষদের একটি নির্দিষ্ট নকশার শু বানানোর ক্রয়াদেশ দিল। তখন তারা কোরিয়া থেকে এই জুতা বানাত। তবে প্রথম ক্রয়াদেশের ৯৭ শতাংশ জুতাই মান উতরে যেতে পারল না। সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্রিনসবার্গ নামের একজন পরামর্শককে আনা হলো। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হলো। শেষ পর্যন্ত উৎপাদিত জুতা বাতিলের হার ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হলো।

১৯৯৪ সালে জাপানে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে আবার বিপদে পড়ে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার। কারণ, তাদের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায়। সমস্যা সমাধানে বাবা-ছেলে একসঙ্গে ইতালিতে গেলেন। অ্যাপেক্স ট্যানারির চামড়ার ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান অ্যাডেলকির মালিক মি. অ্যাডেলকির সঙ্গে দেখা করলেন। ইতালিতে তাঁদের বিশাল জুতার কারখানাও ছিল। সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বললেন, সে সময় অ্যাডেলকিও সমস্যায় ছিল। শ্রমিকের খরচ বেড়ে গেছে। চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তো আমি বললাম, আমাদের এখানে কারখানা করেন। পাত্তা দিলেন না। বললেন, তিনি চীন যাচ্ছেন। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। বললাম কীভাবে যাবেন। বললেন, ব্যাংকক হয়ে চীন। বললাম, ব্যাংকক থেকে ঢাকা তো মাত্র দুই ঘণ্টার দূরত্ব। বললেন, ঢাকায় গিয়ে কী করব? বললাম, জুতার কারখানা করব। তা না করতে চাইলে প্রযুক্তি হস্তান্তর করবেন। প্রয়োজনে তার জন্য আমি অর্থ দেব। বললেন, দেখি।

অ্যাডেলকি চীন গেল। সেখান থেকে আমাকে টেলেক্স করল, আমি আসছি। ঢাকায় আসার পর তাঁর চোখ খুলে গেল। কারখানা দেখে তো রীতিমতো অবাক হয়ে গেল। শেষমেশ সে বলল, আমি তোমাদের কারিগরি জ্ঞান দেব। বিপণন আমি করব। সেই প্রস্তাবে আমরা রাজি হয়ে গেলাম। তারপর ইতালি থেকে অ্যাডেলকির লোকজন এল। পুরো কারখানার ব্যবস্থাপনা তারা বদলে দিল। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে থাকল অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার।

বহুজাতিকের চাকরি ছেড়ে চামড়ায় সফল ব্যবসায়ী
ছবি: সংগৃহীত

২০১৩ সালে অ্যাডেলকির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়। তারপর থেকে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার এককভাবে ব্যবসা করছে। এদিকে তাইওয়ানের গ্রিনল্যান্ড ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে ব্লু ওশান ফুটওয়্যার নামে রপ্তানিমুখী আরেকটি জুতার কারখানার সঙ্গে যুক্ত হন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ও তাঁর ছেলে। সফিপুরে এই কারখানা থেকে ১৩ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের জন্য নারীদের জুতা রপ্তানি করা হচ্ছে।

দেশের বাজারের চাহিদার কথা মাথায় রেখে রপ্তানিমুখী কারখানার উল্টো পাশে আরেকটি কারখানা করলেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। শুরু হলো নতুন এক যাত্রা। বর্তমানে সারা দেশে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের প্রায় ৬০০ বিক্রয়কেন্দ্র আছে। তার মধ্যে অর্ধেকই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। বললেন, জুতার কারখানায় বছরে তিন-চার লাখ জোড়া জুতা উৎপাদন ও রপ্তানি হতো। পরবর্তী সময়ে বছরে উৎপাদন ও রপ্তানি পৌঁছেছিল ৫৫ লাখ জোড়ায় এবং বর্তমানে কোভিড-পরবর্তী সময়ে আনুমানিক উৎপাদন ও রপ্তানি বছরে ৩০ লাখ জোড়া। তার বাইরে দেশের বাজারের জন্য বর্তমানে প্রতি মাসে ২০ লাখ জোড়া এবং বছরে ২ কোটি ৪০ লাখ জোড়া জুতা উৎপাদন করছি আমরা। প্রথমদিকে কষ্ট হলেও আমি লেগে ছিলাম। নাসিমের (সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর) ওপর দিয়েও অনেক ঝড়ঝাপটা গেছে। সে কারণেই আজকের অবস্থানে পৌঁছানো গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *