পিএসজিতে মেসির প্রথম সপ্তাহ কেমন গেল
হোটেল থেকে পিএসজি সমর্থকদের অভিবাদন জানাচ্ছেন মেসিছবি: সংগৃহীত
এক সপ্তাহ হয়ে গেল! বার্সেলোনা ছেড়ে লিওনেল মেসি যে প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ে গেছেন, সে বিস্ময়ও অনেকের এখনো কাটেনি। কিন্তু এর মধ্যেই পিএসজিতে এক সপ্তাহ কেটে গেছে মেসির! বন্ধু নেইমার, আনহেল দি মারিয়া, লিয়ান্দ্রো পারেদেস কিংবা প্যারিসের ফরাসি বিস্ময় কিলিয়ান এমবাপ্পেদের সঙ্গে কেমন কেটেছে মেসির প্রথম সপ্তাহ? ক্লাবের বাইরের জীবনেই–বা কীভাবে মানিয়ে নিয়েছেন?
মঙ্গলবার অনুশীলনে শেষ ম্যাচে তাঁরা জিতলেন। তাঁরাই তো জিতবেন! প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ের পুরো দলের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় অনুশীলন সেশনে লিওনেল মেসি ছিলেন জয়ী দলে এবং দলে তাঁর সঙ্গীরাও কারা ছিলেন—কেইলর নাভাস, নেইমার, আনহেল দি মারিয়া, ইউলিয়ান ড্রাক্সলার ও কিলিয়ান এমবাপ্পে!
হয়তো পিএসজি সমর্থকদের কাছে এমন ভালোবাসায় অভ্যর্থনা পাবেন, মেসি সেটা ভাবতেই পারেননি। না ভাবলে সেটা অস্বাভাবিকও নয়, পুরো ক্যারিয়ারে এর আগে কখনো তো ক্লাব বদলাননি। এ সবকিছুই তাই মেসির কাছে প্রথম।
প্যারিসে, ফ্রান্সে এবং বিশ্বজুড়েই যে ‘মেসিম্যানিয়া’ চলছে, সেটা চোখধাঁধানো। শনিবার স্ত্রাসবুর্গের বিপক্ষে (পিএসজির) ম্যাচের আগে পিএসজির খেলোয়াড় হিসেবে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উপলক্ষে পার্ক দে প্রিন্সেস যেন উৎসাহে ফেটে পড়েছিল! মাঠেও সেদিন ক্লাব দারুণ ফুটবল খেলেছে, একটা পর্যায়ে ৩-০-তে এগিয়ে যাওয়ার পর ম্যাচটা ৪-২ গোলে জিতেছে। এর সবকিছুই মেসির খুব ভালো লেগেছে।
শহর হিসেবে প্যারিস সব সময়ই মেসির পরিবারের খুব পছন্দের ছিল। তাঁর স্ত্রী, আন্তোনেল্লা (রোকুজ্জো) প্রায়ই কেনাকাটার জন্য কিংবা ফ্যাশন উইকে (সাধারণত সেপ্টেম্বরের শেষে বা অক্টোবরের শুরুতে অনুষ্ঠিত হয় এগুলো) যেতেন। দুজন মিলে তাঁদের তিন ছেলে থিয়াগো, মাতেও ও চিরোকে প্যারিসের ডিজনিল্যান্ডে নিয়ে গেছেন অনেকবার।
ছয়বারের ব্যালন ডি’অরজয়ী গত এক সপ্তাহে প্যারিসকে একটা ফুটবলের শহর হিসেবে আবিষ্কার করছেন। এখানকার সমর্থকদের প্যাশন আর তাঁকে ঘিরে এই উচ্ছ্বাস যেমন খুব ভালো লাগছে, তেমনি কিছু মুহূর্ত নিজের মতো করে নীরবেও যে কাটাতে পারছেন, সেটাও ভালো লাগছে মেসির।
প্রতি রাতের জন্য ২০ হাজার ইউরো খরচ করে মেসি এখন যে হোটেলের অভিজাত স্যুটে আপাতত থাকছেন, সেই লো রয়াল মনচো হোটেলে মানুষ তাঁকে শান্তিতেই থাকতে দিচ্ছে।
সোমবার সন্ধ্যায় তিনি ও আন্তোনেল্লা প্রথমবার বাইরে ডিনারের জন্য বেরোলেন, শহরের সেরা ইতালিয়ান রেস্তোঁরাগুলোর একটি চেজারে গেলেন—যে রেস্তোরাঁয় পিএসজির খেলোয়াড় ও তারকারা সাধারণত খেতে যান। শুধু তাঁরা দুজনই বেরিয়েছিলেন সেদিন। আভেন্যু ওচ থেকে আর্ক দো ত্রিয়োম্পের অন্য পাশে আভেন্যু দো ওয়াগ্রার ছোট্ট দূরত্বেই গেছেন এবং সেখানেও কেউই তাঁদের সামনে এসে ভিড় করেননি। রেস্তোরাঁয় শুধু তরুণ দুই ভক্ত এসেছিলেন, মেসি তাঁদের অটোগ্রাফ দিয়েছেন।
শহর আর এর আশপাশের সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মধ্যেই মেসির কাজে নামার প্রস্তুতিও চলছে।
রোববার মেসি অনুশীলনে কিছু রন্ডোতে (সাত-আটজন খেলোয়াড় গোল হয়ে বল দখলে রাখার লড়াইয়ে খেলেন, দু-তিনজন মাঝে থাকেন বল কেড়ে নেওয়ার জন্য) অংশ নিয়েছেন। এরপর টেকবলে (ফুটবল আর টেবিল টেনিসের মিশেলে একটা খেলা, যেটি খেলা হয় বাঁকানো টেবিলের ওপর) মিডফিল্ডার ইদ্রিসা গেয়েকে হারিয়েছেন।
সোমবার তাঁর নতুন সতীর্থরা (মানে জাতীয় দল বা ক্লাব বার্সেলোনায় যাঁদের সঙ্গে এর আগে কখনো খেলেননি) মেসির অংশ নেওয়া প্রথম দলগত অনুশীলন সেশনে মেসির প্রতিভার ধার টের পেয়েছেন।
আর্জেন্টিনাকে কোপা আমেরিকা জেতানোর পর ফুটবলে একটা লাথিও না মারায় তাঁর ম্যাচ ফিটনেসে ঘাটতি আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও অনুশীলনে মেসি ছিলেন দুর্দান্ত। সবাই মুগ্ধ তাঁকে দেখে। অনুশীলনে মূল ড্রিলে তিনি ছিলেন ‘স্বাধীন খেলোয়াড়’, অর্থাৎ দুই ভাগে ভাগ হয়ে ছোট ম্যাচ খেলার সময়ে তিনি ছিলেন দুই দলেরই খেলোয়াড়। তাঁর পায়ে সবকিছুই এত সহজ মনে হচ্ছিল, দারুণ দেখিয়েছেন তিনি।
মঙ্গলবার (পিএসজি কোচ) মরিসিও পচেত্তিনো দুজনের বিপরীতে দুজনের অনুশীলনে মেসির জুটিতে সঙ্গী বানিয়েছিলেন এমবাপ্পেকে। এতটুকু বলা যায় যে দুজনের জুটিটা ভালো জমেছে, অনেক গোল করেছেন তাঁরা। এরপর ছয়জনের বিপরীতে ছয়জন খেলোয়াড়ের ড্রিলেও দুজন একই দলে ছিলেন, সেখানেই প্রথমবার নেইমার, মেসি ও এমবাপ্পে একসঙ্গে খেলেছেন।
মাঠে ও ড্রেসিংরুমে অনেক হাসাহাসি হয়েছে, মজা করেছেন তাঁরা, মেসি খুব সহজেই মানিয়ে নিচ্ছেন সবকিছুর সঙ্গে। রোববার আন্দের এরেরার ৩২তম জন্মদিনে স্বাভাবিকভাবেই ঘরে তাঁকেও নিমন্ত্রণ করা হয়। নেইমার, দি মারিয়া, পারেদেস, নাভাস, মারকিনিওস, ইকার্দিসহ আরও অনেকেই ছিলেন মিডফিল্ডারের (এরেরা) বাসায়। রোববার অনুশীলন শেষে অনুশীলন মাঠেই তৈরি আসাদো (আর্জেন্টাইন ঘরানার বারবিকিউ) মেসির খুব ভালো লেগেছে।
প্রথম সপ্তাহে অন্তত একটা ব্যাপার পরিষ্কার, যদিও মেসি ক্লাবে এসেছেন মাত্র কয়েক দিন হয়েছে, কিন্তু তিনি আসায় অনুশীলনে বাকিদের চেষ্টার মাত্রা বেড়ে গেছে। ‘নিজেরা কত ভালো খেলোয়াড়, সেটাই যেন সবাই ওকে দেখাতে চায়। এমনকি রন্ডোর সময়েও আগের চেয়ে এখনকার পার্থক্যটা চোখে পড়ার মতো। ও আসায় দলের মান এরই মধ্যে বেড়ে গেছে, ক্লাবের সবকিছুতে আবহটাই এখন অবিশ্বাস্য’—নাম না প্রকাশ করার শর্তে ইএসপিএনকে বলেছেন পিএসজির এক সূত্র।
অনুশীলনে মেসি খুশি, পিএসজির জার্সিতে তাঁর অভিষেক কখন হতে পারে সেটির অপেক্ষায় আছেন তিনি। খুব সম্ভবত ২৯ আগস্ট রেঁসের বিপক্ষেই পিএসজির জার্সিতে প্রথম খেলবেন। তবে এসবের মধ্যে নতুন ক্লাবে যাওয়ার পর জীবনের অন্য প্রায়োগিক দিক নিয়েও ভাবতে হচ্ছে মেসিকে। যে তালিকায় সবার ওপরে আছে পরিবারের জন্য নতুন বাড়ি খুঁজে বের করা এবং বাচ্চাদের জন্য স্কুল খোঁজা।
শঁজেলিজের অদূরে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার স্প্যানিশ স্কুলটা হয়তো থিয়াগো, মাতেও ও চিরোকে ছাত্র হিসেবে পেতে পারে। আর ঘরের ক্ষেত্রে—মেসি (বার্সেলোনায়) কাস্তেদেফেলে যে রকম বাড়িতে থাকতেন, সে রকম সুইমিং পুল, বড় বাগানসহ একটা বাড়িই খুঁজছেন। তেমন বাড়ি খুঁজে পেতে তাঁকে প্যারিস থেকে একটু দূরে ন্যইয়ি বা বুজিভালের মতো উপশহরের দিকে যেতে হবে। নেইমার বুজিভালে থাকেন। যদিও তিনি (মেসি) শহরের সীমার মধ্যেই থাকার সিদ্ধান্তও নিতে পারেন।
বার্সেলোনাতে এত বছর তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করা পেপে কস্তা প্রত্যাশিতভাবে প্যারিসেও মেসির সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। ভাগ্য বলতে হবে, প্যারিসে জীবনযাপন সহজ করার মতো পরামর্শ পেতে পেপের কোনো ঝামেলাই হবে না। নিজেরই ছেলে আলভারোর কাছ থেকে সেটা পাবেন পেপে, আলভারো আবার নেইমারের ব্যক্তিগত সহকারী।
মেসি এই মুহূর্তে ফিটনেস ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় আছেন, তবে এর মধ্যে একটা ব্যাপার পরিষ্কার—প্যারিসে তিনি আশপাশে ভালো সঙ্গীই পেয়েছেন।