‘জেনারেল শীত’ ইউক্রেন যুদ্ধকে কী ডিপ ফ্রিজে রাখবে?

মধ্য ইউরোপে যাঁরা বাস করেন, তাঁরা জানেন শীতকাল কতটা ভয়াবহ!
মধ্য ইউরোপে যাঁরা বাস করেন, তাঁরা জানেন শীতকাল কতটা ভয়াবহ! 

মধ্য ইউরোপে যাঁরা বাস করেন, তাঁরা জানেন শীতকাল কতটা ভয়াবহ! নভেম্বর থেকে এপ্রিল—শীতের এই ছয় মাস কাউকে যদি উষ্ণ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বাইরে বের হতে হয়, তাহলে তাঁর অনুভূতি হবে ফ্রিজার বা শীতলীকরণ যন্ত্রের মধ্যে তিনি ঢুকেছেন। সম্প্রতি ইউক্রেনের জনগণের প্রতিরোধস্পৃহাকে গুঁড়িয়ে দিতে দেশটির বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহব্যবস্থা লক্ষ্য করে রাশিয়া সরাসরি বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করছে। এর পেছনে সম্ভবত ‘জেনারেল শীতকালের’ বাস্তবতাটিই কাজ করছে।

যদিও রাশিয়া এখন নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্রের ঘাটতিতে ভুগছে। ইউক্রেনের প্রতিরোধযোদ্ধারা ইরানের সরবরাহ করা শাহেদ-১৩৬ ড্রোন ভূপাতিত করার ক্ষেত্রে সফলতা দেখাচ্ছেন; এরপরও কিছু ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে গিয়ে আঘাত করছে।

ইউক্রেনের বন্ধুরা আমাকে জানিয়েছেন, কিয়েভের বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগের পরিবেশ বিরাজ করলেও মরণপণ লড়াই করতে তাঁরা সংকল্পবদ্ধ। বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্নতার পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য বাজারে ছোট আকারের জেনারেটর কিনতে ভিড় করছেন তাঁরা। দীর্ঘতম শীতে ইউক্রেনের নাগরিকদের টিকে থাকার লড়াই অনেক কঠিন হতে চলেছে। তবে প্রতিপক্ষের সৈন্যদের জন্য শীতকাল যতটা কঠিন হতে চলেছে, তত কঠিন হবে না ইউক্রেনের জন্য। গত মাসগুলোয় ন্যাটো জোট সম্ভাব্য সব উপায়ে ইউক্রেনীয়দের সুরক্ষিত রাখার পরিকল্পনা করেছে। কানাডা তাদের আধুনিক ও কার্যকর সামরিক মজুত থেকে ইউক্রেনকে পাঁচ লাখ সেট উইন্টার গিয়ার বা শীত থেকে রক্ষার সাজসরঞ্জাম দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, এস্তোনিয়াসহ অন্য দেশগুলোও ইউক্রেনকে শীতপোশাক দিয়েছে।

অন্যদিকে, সেনা ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর লজিস্টিক সহায়তা যথাযথভাবে সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর তেমন সুখ্যাতি নেই; বরং দুর্নীতির ক্ষেত্রে খ্যাতি রয়েছে। এ বাস্তবতায় ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সেনারা (তাঁদের মধ্যে দু–তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে পাঠানো সেনাও রয়েছেন) কীভাবে টিকতে পারবেন, সেটা এখন অনেক বড় প্রশ্ন।

রাশিয়ার সৈন্যদের ইউক্রেনীয় বাহিনীকেও মোকাবিলা করতে হবে। উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও যুদ্ধের গতিবেগ এখনো ইউক্রেনের দিকেই। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে জয়-পরাজয় নিষ্পত্তির সবচেয়ে বড় অস্ত্র নৈতিক জোর তাদের পক্ষেই কাজ করেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, ইউক্রেনের সেনারা তাঁদের মাতৃভূমি রক্ষার জন্য যুদ্ধ করছেন এবং এখন তাঁরা রাশিয়ার কাছে দখল হয়ে যাওয়া ভূমি উদ্ধার করছেন। ইউক্রেনীয়দের কাছে এখন ট্যাংকসহ পর্যাপ্ত স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধসরঞ্জাম রয়েছে। তাদের সামরিক নেতৃত্বও নৈতিকতা ও প্রশিক্ষণে এগিয়ে রয়েছে।

সবাই বলছে, ইউক্রেনে কিছুদিনের মধ্যে গভীর শীত নামবে। তাতে যুদ্ধের গতি অনেকটা ধীর হয়ে যাবে। মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রায় শরীরকে যৌক্তিকভাবে উষ্ণ রাখা বাস্তবিক অর্থে কঠিন। সবচেয়ে সেরা যুদ্ধাস্ত্র ও সাজসরঞ্জামে সজ্জিত হওয়ার পরও মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে শীতের যে তীব্রতা, সে পরিবেশে যুদ্ধ করা নিষ্ঠুরতার সমান। জমে যাওয়া হাত দিয়ে সাঁজোয়া যান চালানো কিংবা মেরামত করা, রাইফেল পরিষ্কার করা খুব কঠিন। গোলন্দাজের কিংবা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গোলা থেকে সৈন্যদের জীবন রক্ষার জন্য ১৯১৪ বা ১৯৪১ সালের মতো এখনো পরিখা অত্যাবশ্যক। কিন্তু বরফে আচ্ছাদিত ভূমিতে পরিখা খনন অনেক কঠিন।

রাশিয়া ও ইউক্রেন—দুই পক্ষের হাজার হাজার পদাতিক সৈন্যকে পরিখা খনন ও পরিখার ভেতরে মাটি খুঁড়ে ছাদওয়ালা ছাউনি বানিয়েই যুদ্ধ করতে হবে। দ্বিতীয় ও প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ঠিক একই কায়দায় তাঁদের দাদা ও পরদাদাদের যুদ্ধ করতে হয়েছিল।

‘জেনারেল শীতকাল’ যখন যুদ্ধের গতিটাকে শিথিল করে দিচ্ছে, তখন সব পক্ষের ওপর ভয়ানক চাপ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে
‘জেনারেল শীতকাল’ যখন যুদ্ধের গতিটাকে শিথিল করে দিচ্ছে, তখন সব পক্ষের ওপর ভয়ানক চাপ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে

ব্রাসেলসে সম্প্রতি ন্যাটোর এক কর্তা সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘…এসব বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে যদি আপনাদের যুদ্ধ করতে হয়, যদি আপনাদের ট্যাংক চলার পথে সব সময় বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং সৈন্যরা যদি প্রতিনিয়ত ঠান্ডায় কাঁপতে থাকে, তাহলে সেটা যেকোনো সেনাবাহিনীর নৈতিক বলের ওপর আঘাত হানবে।’

বাস্তবে সেটাই ঘটবে। ইউক্রেনে যে রকম তীব্র শীত নামে, সেই রকম আবহাওয়ায় যুদ্ধ করা ও সামনে এগানোর জন্য একটা সেনাবাহিনীর বিশাল অভিজ্ঞতা ও বিস্তর প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। বরফে জমে যাওয়া আবহাওয়ায় যেকোনো কিছু করার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। এ ধরনের আবহাওয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ ও খাবার সরবরাহ করা কঠিন। বরফে আচ্ছাদিত রাস্তায় ট্রাক চালিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন। কেননা, ট্রাকের চাকা বরফের স্তূপে কিংবা কাদায় আটকে যেতে পারে। এ পরিস্থিতিতে সাঁজোয়া বহর দ্রুত অগ্রসর করানো অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।

লন্ডনের কিংস কলেজের জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো ও ইউক্রেন যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যাকার মাইক মার্টিনের মতে, ‘ধরনের দিক থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ কৌশলের যুদ্ধ। এ ধরনের যুদ্ধের জন্য গতি ও ক্ষিপ্রতা প্রয়োজন। তীব্র শীতের শীতকালে এগুলোর যেকোনোটাই অর্জন করা অনেক কঠিন। সে কারণে শীতকালে, বিশেষ করে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তীব্র শীতের সময় যুদ্ধের গতি কমে যাবে।’

সে পর্যন্ত ইউক্রেনের সেনাদের দক্ষিণ অঞ্চলে নোভা-খাকোভার বাঁধ ও সেতু উদ্ধারে (রাশিয়ার সেনারা যদি সেগুলো ধ্বংস না করেন) মনোনিবেশ করতে হবে। একই সঙ্গে খেরসনের উপকণ্ঠে পৌঁছে যেতে হবে। এতে ক্রিমিয়ার ক্ষেত্রেও তাঁরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন। এ ছাড়া পূর্ব দিকে রাশিয়ার ভাড়াটে সৈন্যদের কাছ থেকে বাখমুট শহরের আশপাশের অঞ্চল রক্ষা করে যেতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *