এত ভারতীয় সিইও মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানে কেন
নভেম্বরে সহপ্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসির জায়গায় টুইটারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হয়েছেন পরাগ আগারওয়াল। এর আগে সত্য নাদেলা, অজয়পাল সিং বাঙ্গা, সুন্দর পিচাইসহ কয়েকজন ভারতীয় সিইও হয়েছেন। ৩৭ বছর বয়সী পরাগের এ পদে বসার পরই গণমাধ্যমের খবর—ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি ব্যবসার সূতিকাগার সিলিকন ভ্যালিতে এত ভারতীয়র দাপট আসলে কেন। বিবিসির এক প্রতিবেদনে সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।
ইন্টারনেট অর্থনীতি ও উচ্চ প্রযুক্তিসংক্রান্ত বাণিজ্যিক কেন্দ্র সিলিকন ভ্যালির অন্যতম প্রভাবশালী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিইও হিসেবে আগারওয়ালের নিয়োগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উচ্ছ্বসিত ভারতীয়রা। এর কারণও আছে। পরাগকে অভিনন্দন জানিয়ে ভারতীয়রা টুইট–রিটুইট করে চলেছেন। এর মধ্যে মাহিন্দ্রা গ্রুপের ব্যবসায়ী আনন্দ মাহিন্দ্রার টুইটটি মজার। তিনি টুইটে লেখেন, ‘এটা কি সিলিকন ভ্যালিতে ভারতীয় সিইও ভাইরাস, যার কোনো টিকা নেই?’ কথাটি কৌতুকের হলেও চমকপ্রদও বটে। কারণ, মাইক্রোসফটের সত্য নাদেলা, গুগলের সুন্দর পিচাইসহ আইবিএম, অ্যাডোব, ভিমিওর মতো ১৭টি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সবাই ভারতীয়।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, আমেরিকার মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ ভারতীয়। কিন্তু সিলিকন ভ্যালিতে জনশক্তির হিসাবে এ সংখ্যা আবার ৬ শতাংশ। এই ৬ শতাংশের মধ্য থেকেই আবার বড় বড় প্রযুক্তি জায়ান্টের শীর্ষ পদে ভারতীয়দের আধিপত্য। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে বিশ্বের শীর্ষ মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভারতীয়রা অবস্থান করে নিচ্ছেন?
টাটা সন্সের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং দ্য মেড ইন ইন্ডিয়া ম্যানেজারের সহলেখক আর গোপালকৃষ্ণান বলেছেন, ভারতীয়রা নিজেদের নাগরিকদের যেভাবে লড়াকু মনোভাবের জন্য প্রশিক্ষণ দেয় বা তৈরি করে, তা আর কোনো জাতি করে না। বিখ্যাত ভারতীয় করপোরেট কৌশলবিদ সি কে প্রহ্লাদের উদ্ধৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘জন্মের শংসাপত্র, মৃত্যুর শংসাপত্র, স্কুলে ভর্তি থেকে চাকরি পাওয়া পর্যন্ত নানা পরিকাঠামোগত অপ্রতুলতার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা অনেক ভারতীয়র ‘প্রাকৃতিক পরিচালক’ হয়ে গড়ে ওঠার পথ তৈরি হয়।’ তিনি বলেন, প্রতিযোগিতা ও বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা ভারতীয়দের সমস্যা সমাধানকারী করে তোলা হয়। তাঁরাই ব্যক্তিগত জীবনের তুলনায় পেশাদার জীবনকে অগ্রাধিকার দেন, আর আমেরিকান অফিসে অতিরিক্ত কাজের সংস্কৃতিতেও তাঁরা অভিযোজিত হয়ে যান। এসব বৈশিষ্ট্য বিশ্বনেতাদের কাতারে ভারতীয়দের জায়গা করে দেয়।
ভারত তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষাকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছে অনেক আগেই। এর জন্য নানা পদক্ষেপও নিয়েছে। পদক্ষেপগুলোর মধ্য অন্যতম একটি হলো ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউটস অব টেকনোলজি (আইআইটি)। দেশজুড়ে এর বিভিন্ন শাখায় হাজারো শিক্ষার্থী সরকারি খরচে পড়াশোনা করে। ১৯৮০-এর দশকে আইআইটির শিক্ষার্থীরা উন্নত সুযোগ-সুবিধা পেতে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন শুরু করেন। তাঁরা এখন সেই মার্কিন ভূখণ্ডে সাফল্যের নতুন নতুন রেকর্ড গড়ে চলেছেন।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত সিলিকন ভ্যালির সিইওরাও দেশটির ৪০ লাখ সংখ্যালঘু অংশের প্রতিনিধি, যাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী এবং সবচেয়ে শিক্ষিতদেরও অংশ। এই ৪০ লাখের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী। আর এটি ১৯৬০–এর দশকে মার্কিন অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তনের ফলেই সম্ভব হয়েছে।
ভারতের এইচসিএল টেকনোলজিসের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা অজিত কুমার বলেন, আশির দশকে যখন কম্পিউটার সায়েন্স ও ইলেকট্রনিকসে মাস্টার্স করতে আসা ভারতীয়দের সংখ্যা বাড়ছিল, ঠিক তখনই আমেরিকানদের মধ্যে এই দুটি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ঝোঁক কমছিল। সে সময়ে মার্কিন প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ পাওয়া ভারতীয়রা আজ উচ্চপদে উঠে এসেছেন। সে জন্য আজ যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবীদের উল্লেখযোগ্য অংশই ভারতীয়।
শীর্ষ পদে উঠে আসা সুন্দর পিচাই, সত্য নাদেলা, পরাগ আগারওয়ালসহ সব সিইও তাঁদের নিজস্ব পথেই চলছেন। তবে সবার উত্থানের পেছনে কিছু অনুঘটক প্রায় একই বলে অনুমান করা হয়। যেমন ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞান ও গণিতের ওপর বেশি জোর দেওয়া। বেশির ভাগ ভারতীয় মা–বাবা সন্তানদের এসব বিষয়ে পড়াশোনার জন্য তাগিদ দেন। আর শিক্ষার্থীদের বোঝানো হয়, এসব বিষয়ে দক্ষতা ক্যারিয়ারে সাফল্যের চাবিকাঠি। পরাগ আগারওয়াল টুইটারের সিইও হওয়ার পর তাঁর মা বলেছেন, ‘পরাগ ছোট থেকেই কম্পিউটার ও মোটরকার ভালোবাসত; আর অঙ্ক ছিল ওর প্রিয় বিষয়।’
১৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারতে শিক্ষাক্ষেত্রে রয়েছে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা। অল্পসংখ্যক ছাত্রই আইআইটিতে ভর্তি হওয়ার মতো সুযোগ পান। চলতি বছর আইআইটির ১৬ হাজার আসনের বিপরীতে ২২ লাখের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন।
একটি বহুজাতিক বাণিজ্যিক পরামর্শক সংস্থার অংশীদার অবসরপ্রাপ্ত অশোক আলেক্সান্ডার বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির চেয়ে আমাদের আইআইটিতে ভর্তি হতে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত চেষ্টা ও পছন্দ বড় ভূমিকা রাখে।