ইউক্রেনে রুশ হামলা ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের অধিকার
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত মোট নয়জন মহাসচিব এই বিশ্ব সংস্থার নেতৃত্বভার গ্রহণ করেছেন। অধিকাংশই তাঁদের শক্ত শিরদাঁড়ার জন্য সুপরিচিত নন। এক বড় ব্যতিক্রম দাগ হ্যামারশোল্ড। বিশ্ব সংস্থার প্রধান হলেও প্রত্যেক মহাসচিবকে বৃহৎ শক্তিগুলোর মন জুগিয়ে চলতে হয়, কারণ তাদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়লে সংস্থা অকেজো হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
তা সত্ত্বেও নিজের নীতিগত অবস্থানে অবিচল থাকলে মহাসচিব কেবল নিজের জন্যই বাড়তি সম্মান বয়ে আনেন না, বিশ্ব সংস্থার জন্যও বিশ্ববাসীর আস্থা অর্জন করেন। দাগ হ্যামারশোল্ড এই নীতিগত দৃঢ়তার জন্যই আমাদের শ্রদ্ধা কুড়িয়েছেন। বৃহৎ শক্তির কাছে অসন্তুষ্ট হবেন জেনেও দাগ হ্যামারশোল্ড ১৯৫৬ সালে যুক্তরাজ্যের মিসরে হামলা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ক্ষমতাবানদের জন্য এক রকম আইন; ক্ষুদ্র ও দুর্বল দেশসমূহের জন্য আরেক রকম আইন, তা হতে পারে না।
দুর্বল প্রতিবেশী ইউক্রেনের ওপর হামলা চালানোর পর জাতিসংঘের চলতি মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজ রাশিয়ার প্রতি যে ভাষায় সমালোচনা করেছেন, তা দাগ হ্যামারশোল্ডের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেন প্রশ্নে বিতর্কে রাশিয়ার প্রতি তর্জনী উঁচিয়ে তিনি বলেছেন, নিরীহ মানুষ মরছে, তা ঠেকাতে রাশিয়াকে এখনই হামলা বন্ধ করতে হবে। ইউক্রেনের বুচায় নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করার পর তিনি রাশিয়াকে যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত করেছেন।
ক্রেমলিনে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাতের সময় তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সনদে স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের একটি স্থায়ী সদস্য হিসেবে রাশিয়া এই নীতি রক্ষায় ও তার বাস্তবায়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
জাতিসংঘ সনদ ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের অধিকার
একটা সময় ছিল যখন বৃহৎ শক্তিধর দেশ কারণে-অকারণে প্রতিবেশীর ওপর হামলা করলেও তার প্রতিবাদ করার কোনো সর্বজন গৃহীত আইনগত ভিত্তি ছিল না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এই অবস্থার পরিবর্তন হয়। তিন বৃহৎ শক্তিধর দেশ—যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে নতুন আন্তর্জাতিক আইনভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলে, তার কেন্দ্রে রাখা হয় জাতিসংঘকে।
বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রসহ সব সদস্যরাষ্ট্রের সম্মতির ভিত্তিতে যে জাতিসংঘ সনদ গৃহীত হয়, তাকে আমরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ‘চূড়ান্ত শাসনতন্ত্র’ বলে বর্ণনা করতে পারি। কোনো রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র যেমন তার অভ্যন্তরীণ ঠিক-বেঠিক নির্ধারণে প্রধান ব্যারোমিটার, তেমনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব রাষ্ট্রের ব্যবহারের চূড়ান্ত মানদণ্ড এই জাতিসংঘ সনদ। দুর্ভাগ্য এই যে যারাই এই ‘চূড়ান্ত শাসনতন্ত্রের’ প্রণেতা, তারাই বারবার তার লঙ্ঘন করেছে। ইউক্রেনে রুশ হামলা সে প্রবণতার সর্বশেষ উদাহরণ।
আন্তোনিও গুতেরেস রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে জাতিসংঘ সনদের যে ধারা লঙ্ঘনের কথা স্মরণ করিয়ে দেন, তা হলো দ্বিতীয় ধারার চতুর্থ উপধারা, যেখানে স্পষ্ট বলা আছে, সংস্থার সব সদস্যরাষ্ট্র তাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ বা বলপ্রয়োগের হুমকি প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকবে অথবা এমন কিছু করবে না, যা এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
এই সনদ ছাড়াও জাতিসংঘ গত ৭৫ বছরে আরও অসংখ্য নীতিমালা ঘোষণা করেছে, যার মোদ্দা কথা, সব দেশ, তা তারা ছোট হোক অথবা বড়, সবার সমান অধিকার। প্রতিটি সদস্যদেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে। এমনকি কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ নীতিমালার বিরুদ্ধে কোনো রকম প্রচারণা না করতেও সংস্থার প্রতিটি সদস্যদেশ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
বলাই বাহুল্য, এসবই কাগুজে ঘোষণা। যেসব বৃহৎ ও শক্তিধর দেশের উৎসাহে ও ব্যবস্থাপনায় এসব মন ভোলানো ঘোষণা গৃহীত হয়, তারাই বারবার তার লঙ্ঘন করেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা সেই দীর্ঘ ইতিহাসের সর্বশেষ উদাহরণ মাত্র।
মজার কথা হলো, ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরুর আগে রাশিয়া যে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটি প্রকাশ করে, তাতেও হামলার পক্ষে সাফাই গাইতে জাতিসংঘ সনদের দোহাই দেওয়া হয়েছে। এই সনদের ৫১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো দেশ আক্রান্ত হলে একক অথবা যৌথভাবে প্রতিরক্ষার অধিকার তাদের রয়েছে। এই ধারায় এ কথাও বলা হয়েছে, বহিরাগত হামলা থেকে প্রতিরক্ষায় কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সে কথা তারা অবিলম্বে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে অবহিত করবে। তবে তারা এমন কিছুই করবে না, যার ফলে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব ও অধিকার কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন হয়।
রুশ ব্যাখ্যানুসারে এই ধারায় বহিরাগত হামলা রোধে আগাম হামলার আইনগত অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। মস্কোর দাবি ছিল, ইউক্রেন পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে এবং দনবাসে রুশ ভাষাভাষী নাগরিকদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে। এটা ঠেকাতেই আগাম হামলা। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র এই ৫১ ধারার উদাহরণ টেনেছিল। মার্কিন যুক্তিতে, ইরাকের পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, যা সে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। তা ঠেকাতেই প্রয়োজন আগাম হামলা।
বলা বাহুল্য, ইরাক বা ইউক্রেন উভয় ক্ষেত্রেই আত্মরক্ষার জন্য আগাম হামলার দাবি আন্তর্জাতিক আইনের চোখে অসার, কারণ ইরাক বা ইউক্রেন কেউই যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার বিরুদ্ধে আগ্রাসী হামলায় জড়িত ছিল না। ইরাকের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের দাবি মিথ্যা। ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ ও রুশ ভাষাভাষী ইউক্রেনীয় নাগরিকদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।
মিয়ারশাইমার বনাম কটকিন
কোনো কোনো বামপন্থী মহলে, বিশেষত যাঁরা এখনো মস্কোতে বৃষ্টি হলে ঢাকায় বা দিল্লিতে ছাতা মেলে ধরেন, তাঁরা রুশ হামলার সমর্থনে যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, সব দোষ ইউক্রেনের। তাঁরাই রাশিয়াকে এই হামলায় উসকানি দিয়েছেন। ইউক্রেন রুশ প্রভাব-বলয় থেকে বেরিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যপদ প্রার্থনা করেছিল, সেটাই উসকানি। কারণ, এর ফলে রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই যুক্তি যে অকাট্য, তা প্রমাণের জন্য এদের অনেকেই শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন মিয়ারশাইমার উদাহরণ দিয়ে থাকেন।
ন্যাটোর সদস্যপদ সম্প্রসারণের সমালোচনা করে মিয়ারশাইমার অনেক দিন থেকেই লেখালেখি করছেন। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর ফরেন অ্যাফেয়ার্স পত্রিকায় এক প্রবন্ধে তিনি রুশ ভালুককে খেপিয়ে না তোলার ব্যাপারে মার্কিন নেতৃত্বকে পরামর্শ দেন। তাঁর কথায়, সেটাই হবে বাস্তববাদী পথ। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রুশ হামলার পর নিউইয়র্কার পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সে যুক্তি তিনি নতুন করে হাজির করেন।
মিয়ারশাইমার বলেন, রাশিয়ার সামরিক হামলা মোটেই সাম্রাজ্যবাদী হামলা নয়, এটি কেবল বৃহৎ শক্তির রাজনীতি। ইউক্রেনের মতো কোনো দেশ যদি রাশিয়ার মতো বৃহৎ শক্তির প্রতিবেশী হয়, তাহলে পরম শক্তিধর সে দেশ তাদের (অর্থাৎ ইউক্রেনের) গৃহীত ব্যবস্থায় কী প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, সে হিসাবটা মাথায় রাখতে হবে। মিয়ারশাইমারের কথায়, ‘তুমি যদি একটা কাঠি নিয়ে রাশিয়ার মতো পরাশক্তির চোখ ডলে দাও, তাহলে সে তো পাল্টা আঘাত হানবেই।’ অর্থাৎ ক্ষিপ্ত ভালুক তেড়েফুঁড়ে আসতে পারে।
এ কথার অর্থ, বৃহৎ শক্তিধর দেশ যাতে কোনোক্রমেই ক্ষিপ্ত না হয়, তা নিশ্চিত করার বা তার মন জুগিয়ে চলার দায়িত্ব ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের। এই যুক্তি মেনে নিলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরুর জন্য হিটলারকে কোনোভাবেই অভিযুক্ত করা যায় না। দোষ তো পোল্যান্ডের, তারাই তো সে দেশের জার্মান ভাষাভাষী নাগরিকদের ওপর অত্যাচার করেছে। তাদের রক্ষা করতেই তো বৃহৎ শক্তিধর দেশ জার্মানি ক্ষুদ্র প্রতিবেশী পোল্যান্ডকে আক্রমণ করে বসে।
বস্তুত, পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক হামলা শুরুর আগের রাতে এক বেতার ভাষণে হিটলার এই আক্রমণকে ‘আত্মরক্ষামূলক’ বলেই বর্ণনা করেন। ঠিক একই যুক্তিতে ১৯৩৯ সালে হিটলার আরেক ক্ষুদ্র প্রতিবেশী চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ করেছিলেন।
বৃহৎ শক্তিধর দেশ যেকোনো কারণেই তা সত্যি অথবা মনগড়া হোক না কেন, ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর ওপর নাখোশ হতে পারে। তাকে খুশি রাখতে প্রতিবেশী ক্ষুদ্র দেশটিকে চিরকাল নতজানু হয়ে থাকতে হবে, এ কোনো কাজের কথা নয়।
১৯৩৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন দাবি করেছিল, তার প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে প্রতিবেশী ফিনল্যান্ডকে এক বিশাল এলাকা ছেড়ে দিতে হবে। জার্মানরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ফিনল্যান্ড সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণে থাকলে সে দেশ ‘বাফার’ হিসেবে কাজ করবে। সে দাবি না মানায় নাখোশ মস্কো ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে বসে। সে আক্রমণ যে জায়েজ, এ কথা কেউ বলে না।
ইউক্রেনের ক্ষেত্রে আজ হোক বা কাল রাশিয়া তাকে গিলে খেতে উদ্যত হতো, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। প্রেসিডেন্ট পুতিন নিজেই বারবার ইউক্রেনের স্বাধীনতাকে কাল্পনিক বর্ণনা করে সে দেশকে রুশ সাম্রাজ্যের স্বাভাবিক সম্প্রসারণ বলে চিহ্নিত করেছেন। ইউক্রেন রাশিয়ারই অংশ হয়ে থাকত, যদি না সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা ভ্লাদিমির লেনিন তাকে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মর্যাদা দিতেন। পুতিন নানাভাবে এ কথা আমাদের জানিয়েছেন, লেনিনের করা এই ঐতিহাসিক ভুল সংশোধনে তিনি বদ্ধপরিকর।
সোভিয়েত ও রুশ ইতিহাসের খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিফেন কটকিন মিয়ারশাইমারের ‘উসকানি তত্ত্বে’র বিপরীতে বলেছেন, ন্যাটো সম্প্রসারণ হোক বা না হোক, পুতিন ইউক্রেনের ওপর থাবা বসাতেনই, শুধু অপেক্ষায় ছিলেন মোক্ষম এক সময়ের। উনিশ শতকেও রাশিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন একজন একনায়ক, ক্ষমতা ধরে রাখার লক্ষ্যে যিনি নিজ নাগরিকদের ওপর নির্বিচার অত্যাচার চালিয়েছেন, সামরিক শক্তি ব্যবহার করে প্রতিবেশী রাজ্য দখলে এনেছেন এবং সব সময়ই তাঁরা বিদেশিদের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে এসেছেন।
ফরেইন অ্যাফেয়ার্স পত্রিকায় এক নিবন্ধে কটকিন লিখেছেন, বিগত অর্ধসহস্রাব্দ ধরে রাশিয়ার বৈদেশিক নীতির কেন্দ্রে উচ্চাভিলাষী আগ্রাসী মনোভাব কাজ করেছে। ষোলো শতকে আইভান দি টেরিবলের সময় থেকে সেই যে সম্প্রসারণবাদী অভিযান শুরু, তার ফলে রাশিয়া গড়ে প্রতিদিন ৫০ বর্গমাইল পরের জমি নিজের দখলে এনেছে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে রুশ সাম্রাজ্য এতটা বিশাল হয়ে পড়ে যে বিশ্বের ভূভাগের এক-ষষ্ঠাংশ তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এই সম্প্রসারণবাদী রাজনীতির অংশ হিসেবে আজ হোক বা কাল, ইউক্রেনের ওপর এই হামলা হতোই।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ার প্রতিবেশী প্রতিটি ক্ষুদ্র দেশ কোনো না কোনো সময় তার আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। সে কথা স্মরণ করে পোল্যান্ডের বৈদেশিক মন্ত্রী জবিগনিউ রাউ বলেছেন, রাশিয়া তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এ কথা ঠিক। কিন্তু আমাদের নিরাপত্তার কী হবে? রাশিয়ার তো পারমাণবিক অস্ত্র আছে, বৃহৎ সামরিক বহর রয়েছে। হামলা হলে নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা তার রয়েছে। কিন্তু আমরা আক্রান্ত হলে কীভাবে রক্ষা পাব?
পুতিনকে থামাতেই হবে
আত্মরক্ষার জন্যই রাশিয়া ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযানে’ নেমেছে—পুতিনের এ যুক্তি অসার, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ এক প্রস্তাবে সে কথা স্পষ্টভাবেই ঘোষণা করেছে। ২ মার্চ সংস্থার ১৪১টি সদস্যের সমর্থনে গৃহীত এ প্রস্তাবে রাশিয়াকে অবিলম্বে ও শর্তহীনভাবে ইউক্রেনে তাদের অভিযান বন্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও নিরাপত্তা পরিষদের একটি স্থায়ী সদস্য হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়া এ প্রস্তাবের প্রতি কর্ণপাতের প্রয়োজন দেখেনি। ইউক্রেনে সে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি ঘুরে এসে জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস বলেছেন, সেখানে যা হয়ে চলেছে, তা এককথায় নারকীয়। তিনি বলেছেন, ‘বুচাতে আমি অশুভর চেহারা দেখেছি।’
রাশিয়া ও তার আদর্শিক মিত্ররা এ যুদ্ধের পক্ষের যত সাফাই দিক না কেন, এ কথায় কোনো সন্দেহ নেই একুশ শতকে পারমাণবিক শক্তিধর একটি দেশ তার দুর্বল প্রতিবেশীর ওপর হামলা চালাবে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। স্লোভেনিয়ার খ্যাতনামা দার্শনিক স্লাভোয় জিজেক এক নিবন্ধে বলেছেন, রাশিয়ার দাবি তারা বাধ্য হয়েই এ আক্রমণ করেছে। বৃহৎ এক দেশ তার দুর্বল প্রতিবেশীকে বাধ্য হয়ে আক্রমণ করেছে এবং তাকে সে সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেবে, এ কথা কিছুতেই কোনো যুক্তিতেই মানা যায় না। জিজেক জোর দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা যেন কিছুতেই রাশিয়াকে তার মনগড়া যুক্তিতে এ যুদ্ধের পক্ষে সাফাই গেয়ে পার পেতে সাহায্য না করি।’
যাঁরা এখনো মস্কোর পক্ষে মায়াকান্না করছেন, জিজেকের এ পরামর্শটুকু বিবেচনায় আনলে সততার পরিচয় দেবেন।