অর্থনৈতিক বিশ্বযুদ্ধ কি শুরু হয়েই গেল
যুদ্ধের খবর পেলেই গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমার গুপীর সেই গানটার কথাই বেশি মনে হয়। গল্পটা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর হলেও গানটি লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায় নিজেই। গুপীর গানের কয়েকটা লাইন ছিল এ রকম—‘ওরে হাল্লারাজার সেনা/ তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল।/ মিথ্যে অস্ত্রশস্ত্র ধরে/ প্রাণটা কেন যায় বেঘোরে,/ রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল/ তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল।’
যদিও জানি বাস্তবে যুদ্ধের ময়দানে গান গেয়ে যুদ্ধ থামানো যায় না। যুদ্ধ আসলে রোমাঞ্চকর কিছু না। যুদ্ধ কতটা ভয়াবহ, যুদ্ধ যে গায়ক, নায়ক, লেখক বা শিশু কাউকেই ছাড় দেয় না, তা বোঝাতে স্টিফেন স্পিলবার্গ তাঁর সেভিং প্রাইভেট রায়ান সিনেমায় প্রায় প্রথম ২০ মিনিট কেবল ভয়াবহ যুদ্ধই দেখিয়েছিলেন।
এই পৃথিবী কখনোই যুদ্ধবিহীন ছিল না। তবে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপে যুদ্ধ ফিরে আসাটাই অনেক বড় ঘটনা। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর হবে কি না, সেই প্রশ্ন মাথায় নিয়েই বলা যায়, এখন যে যুদ্ধ শুরু হলো—এটা কি প্রথম অর্থনৈতিক বিশ্বযুদ্ধ?
যুদ্ধের অর্থনীতি ও মহাবিভ্রম
আধুনিক বিশ্বে যুদ্ধ নিয়ে যেকোনো আলোচনায় দ্য গ্রেট ইলিউশন বইটার প্রসঙ্গ এসেই পড়ে। এর লেখক ছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, লেখক ও শান্তিবাদী রালফ নর্মান অ্যাঞ্জেল। বইটির প্রকাশিত হয়েছিল অবশ্য বেশ আগে—১৯০৯ সালে।
নর্মান অ্যাঞ্জেল লিখেছিলেন, আসলে একটি যুদ্ধের অর্থনৈতিক ক্ষতি এত বেশি যে যুদ্ধ শুরু করে কেউ আসলে শেষ পর্যন্ত লাভবান হয় না। বরং যুদ্ধের পরিণতি হবে বিপর্যয়কর। এ কারণে সাধারণভাবে বলা যায়, ইউরোপে যুদ্ধ আর হবে না, হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কারণ, যুদ্ধ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে অযৌক্তিক। আর শিল্পোন্নত দেশের মধ্যে যুদ্ধ আরও নিরর্থক। বিজয়ী হলেও তা থেকে অর্থ পাওয়া যাবে না। সুতরাং যুদ্ধের মাধ্যমে একটি জাতি লাভবান হয় বলে যদি কেউ মনে করেন, তাহলে সেটাই আসল ‘গ্রেট ইলিউশন’ বা মহাবিভ্রম। নর্মান অ্যাঞ্জেল মনে করতেন, শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অর্থনীতিতে পারস্পরিক নির্ভরতাই হবে একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের ভালো আচরণের প্রকৃত রক্ষাকবচ। কারণ, যুদ্ধ জড়িত সব দেশের জন্যই অর্থনৈতিকভাবে তা ক্ষতিকারক হবে।’
নানা কারণে বইটি এখনো বিখ্যাত হয়ে আছে। বিশেষ করে একটি দেশের সঙ্গে আরেকটি দেশের সম্পর্ক স্থাপনের নীতি কী হবে, তার একটি বড় দিকনির্দেশনামূলক বই এটি। প্রকাশ হতেই বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল বইটি। তবে কয়েক বছরের মধ্যেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বেশ সমালোচনায় পড়েন নর্মান অ্যাঞ্জেল। অবশ্য তার সমর্থকেরা বলছেন, নর্মান অর্থনীতির যে শক্তি, ক্ষমতা ও গুরুত্বের কথা বলেছিলেন, তা বুঝতেই পারেনি ইউরোপের দেশগুলো। ফলে যুদ্ধ আর বন্ধ হয়নি। সুতরাং নর্মান অ্যাঞ্জেলের বক্তব্যের গুরুত্ব সবাই মেনে চলেন। এ কারণে ১৯৩০-এর দশকের মধ্যেই বইটির ছয়টি সংস্করণ বের হয়ে যায় এবং ১৯৩৩ সালে তিনি এর জন্য শান্তিতে নোবেলও পান।