ভারত–চীন সীমান্ত বিরোধ: ৬০ বছরের পুরোনো যে লড়াই

চীন সীমান্তে ভারতের অরুনাচল প্রদেশ রাজ্যের বুমলায় একটি সাইনবোর্ড। ছবিটি ২০০৯ সালে তোলা
চীন সীমান্তে ভারতের অরুনাচল প্রদেশ রাজ্যের বুমলায় একটি সাইনবোর্ড। ছবিটি ২০০৯ সালে তোলা

২৩ অক্টোবর ১৯৬২। শরতের সেই সকালে চীনের সেনারা ভারতীয় সীমান্তে ঢুকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। উত্তর–পূর্ব ভারতের হিমালয় অঞ্চলে ঘটে এ ঘটনা। চীন ও ভুটান সীমান্তবর্তী ওই এলাকাটি তখন নর্থ–ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজিন্সি বা এনইএফএ নামে পরিচিত।

এখন সেই অঞ্চল ভারতের একটি রাজ্য। নাম অরুণাচল প্রদেশ। ১০ লাখের বেশি মানুষের বাস সেখানে। এ পর্যন্ত চীন অরুণাচলকে নিজেদের অঞ্চল বলে দাবি করে আসছে। সেখানে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সর্বশেষ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

চীন ও ভারতের এই দ্বন্দ্ব নিয়ে একটি বই লিখেছেন সুইডিশ সাংবাদিক ও লেখক বার্টিল লিন্টনার। বইটির নাম ‘চায়নাস ইন্ডিয়া ওয়ার: কলিশন কোর্স অন দ্য রুফ অব দ্য ওয়ার্ল্ড। তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরণে আকাশ আলোকিত হয়েছিল ও প্রতিধ্বনিত হয়েছিল পাহাড়ে।’

ভারতের একটি অবস্থানে ঢুকে চীনের সেনারা ১৭ জন ভারতীয় সেনাকে হত্যা ও ১৩ জনকে ধরে নিয়ে যায়। ভারতীয় সেনাদের কাছে তেমন অস্ত্র ছিল না। এ কারণে তারা চীনা সেনাদের বিরুদ্ধে তেমন প্রতিরোধও গড়তে পারেনি সেদিন। পরদিন পাশের একটি উপত্যকায় হামলা চালিয়ে চীন বৌদ্ধ বিহারের ছোট্ট এক শহর তাওয়াং দখল করে নেয়।

এরপর চীনের সেনারা দক্ষিণে অগ্রসর হয়। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে পাহাড়ের কাছে বোমদিলা নামে বৌদ্ধ বিহারের আরও একটি ছোট্ট শহরে পৌঁছে যায়। চা–বাগান, তেলের খনি ও পাটখেতের জন্য বিখ্যাত ভারতের আসাম থেকে শহরটি ২৫০ কিলোমিটার দূরে।

এরপর ২১ নভেম্বর চীনারা অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করে এবং দুই দেশের মধ্যে সীমানা নির্ধারণকারী প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বা এলএসি থেকে উত্তরে ২০ কিলোমিটার দূরে সরে যায়। ব্রিটিশশাসিত ভারতে এই এলএসির মাধ্যমে দুই দেশের সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল।
বার্টিল লিন্টনার বলেন, যুদ্ধ শেষ হয়। কিন্ত এর কয়েক দিন পরই চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) সেনারা হিমালয়ে চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকা অংশে সরে যায়। ভারতের দেওয়া হিসাবে সে যুদ্ধে দেশটির ১ হাজার ৩৮৩ জন সেনা নিহত ও আরও প্রায় ১ হাজার ৭০০ সেনা নিখোঁজ হন। চীনের হিসাবে এই যুদ্ধে ভারতের ৪ হাজার ৯০০ সেনা নিহত হয়েছিলেন এবং এ ছাড়া ৩ হাজার ৯৬৮ সেনাকে জীবিত আটক করেছিল তারা।  

ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ও আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য ইন্ডিয়া চায়না বর্ডার নামে নতুন একটি বইয়ের লেখক মনোজ জোশী বলছেন, চীন কেন সেনা প্রত্যাহার করেছিল, তা স্পষ্ট নয়।

মনোজ জোশী নিজেও এখনো বিষয়টি নিয়ে সন্দিহান। তাই তো প্রশ্ন তুলে বললেন, এর কারণে কি তাদের সরবরাহ লাইন বাড়ানো হয়েছিল? তারা কি যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে ভীত ছিল? নাকি তারা তাদের পূর্বের সীমান্ত দাবির ব্যাপারটিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি তখন?

চীন ও ভারতের মধ্যে বিতর্কিত সীমান্ত তিনটি এলাকায় বিভক্ত। একটি হচ্ছে লাদাখকে ঘিরে ওয়েস্টার্ন সেক্টর। দ্বিতীয়টি তিব্বত সীমান্তলাগোয়া ভারতের হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড রাজ্য নিয়ে তৈরি সীমানা ও তৃতীয়টি অরুণাচল সীমান্তে থাকা ইস্টার্ন সেক্টর।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা প্রকৃতই কল্পিত একটি সীমারেখা। ভারত বলছে, এটা ৩ হাজার ৪৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ। এদিকে চীন বলছে, সীমানা দুই হাজার কিলোমিটারের কিছু বেশি।

ভারত দাবি করে, আকসাই চিনের মালভূমি। সুইজারল্যান্ডের আয়তনের সমান একটি এলাকা যা চীন সীমান্তের পশ্চিম অংশে নিয়ন্ত্রণ করে। চীন অরুণাচল প্রদেশ দাবি করে।

ভারতের অরুনাচল প্রদেশের চীন সীমান্ত–সংলগ্ন তেজপুর–তাওয়াং মহাসড়কে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ট্রাক চলছে। ছবিটি ২০১২ সালের মে মাসে তোলা
ভারতের অরুনাচল প্রদেশের চীন সীমান্ত–সংলগ্ন তেজপুর–তাওয়াং মহাসড়কে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ট্রাক চলছে। ছবিটি ২০১২ সালের মে মাসে তোলা

ভারতের দাবি অনুযায়ী পূর্বাঞ্চলীয় সীমানা ১ হাজার ১২৬ কিলোমিটার। তবে ম্যাকমোহন লাইন দ্বারা নির্ধারিত অরুণাচল প্রদেশের এই সীমানার স্বীকৃতি চীন কখনোই দেয়নি। ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হেনরি ম্যাকমোহনের নামে এর নামকরণ।

এশিয়ার দুই বৃহৎ দেশ ও একই সঙ্গে পারমাণবিক ক্ষমতাধর দুই প্রতিবেশী বিশ্বের সবচেয়ে বিতর্কিত সীমানা হিসেবে পরিচিত এই সীমান্তে সংঘাত–সংঘর্ষ এড়াতে একাধিকবার চুক্তি ও সমঝোতা করেছে। দুই পক্ষই অবশ্য বেশির ভাগ সময় শান্ত থাকে। কিন্তু নিয়মিত সীমা লঙ্ঘন ও অনুপ্রবেশের জন্য একে অপরকে দোষারোপ করে আসছে।

তবে অরুণাচলকে নিজেদের ভূখণ্ড হিসেবে করা থেকে চীন কখনো সরে আসেনি। এখনো অরুণাচলের বেশির ভাগ এলাকাকে ‘দক্ষিণ তিব্বত’ নামে ডাকে বেইজিং। গত বছর চীনের বেসামরিকবিষয়ক মন্ত্রণালয় বিতর্ক ওই এলাকার কিছু অংশের নতুন নাম দেয়। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম বলে, ঐতিহাসিক ও প্রশাসনিক ভিত্তিতে এ দাবি তাদের।

কিছু বিশ্লেষকের মতে, বেইজিং ভারতের সঙ্গে একটি চূড়ান্ত সীমান্ত চুক্তিতে অরুণাচল প্রদেশকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, যা দিল্লিকে আকসাই চিনের ওপর চীনা সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে বাধ্য করবে। আকসাই চিন হলো কাশ্মীরের পাশে বরোচ্ছাদিত একটি মরুভূমি এলাকা। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ এলাকা ১৯৫০–এর দশকে দখল করে নেয় চীন। বিপরীতে অরুণাচল প্রদেশের ওপর ভারতীয় সার্বভৌমত্বের বিষয়টি মেনে নেয় বেইজিং।

তবে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহামের শেরিং তোপগালের মতো বিশেষজ্ঞরা আবার উল্লিখিত যে কারণের কথা বলা হলো, তা এখন আর কারণ নয় বলে মনে করেন।